বিপিএল

স্বপ্নে বাঁচছেন লামিচানে

জুবাইর

জুবাইর
প্রকাশের তারিখ: 16:05 শুক্রবার, 11 জানুয়ারি, 2019

|| ক্রিকফ্রেঞ্জি করেসপন্ডেন্ট ||

সিলেট সিক্সার্সের হয়ে বাংলাদেশ প্রিমিয়ার লীগে (বিপিএল) খেলছেন নেপাল ক্রিকেটের সবচেয়ে বড় বিজ্ঞাপন সন্দ্বীপ লামিচানে। মাত্র ১৮ বছর বয়সেই আইপিএল, বিগ ব্যাশ, সিপিএল ও বিপিএলে খেলে ফেলা তরুণ এই লেগ স্পিনার তাঁর ক্যারিয়ারের উত্থান সম্পর্কে ক্রিকফ্রেঞ্জির সাথে বিস্তারিত আলাপ করেছেন।

পাঠকদের সুবিধার্থে সাক্ষাৎকারটি তুলে ধরা হলো...

ক্রিকফ্রেঞ্জিঃ দুই বছর আগে আপনি বলেছিলেন, বিগ ব্যাশে খেলতে পারলে আপনার স্বপ্ন পূরণ হবে। এখন আপনি বিগ ব্যাশ খেলছেন, বিষয়টিকে কিভাবে দেখছেন?

লামিচানেঃ যখন আমি প্রথম অস্ট্রেলিয়া যাই, তখন আমি এবং মাইকেল ক্লার্ক মিডিয়ার সাথে কথা বলছিলাম। তখন আমি বিগ ব্যাশের কথা বলেছিলাম। আমি এশিয়া, ইংল্যান্ডে খেলেছি। আমার অস্ট্রেলিয়ায় খেলা বাকি ছিল। আর অস্ট্রেলিয়ায় খেলার একটাই সুযোগ ছিল, সেটা বিগ ব্যাশের মাধ্যমে। মনে জোর ছিল, আমাকে বিগ ব্যাশ খেলতেই হবে। অস্ট্রেলিয়ায় খেলতে পারলে আমার দেশ, আমার বাবা-মা, নেপালের সবাই আমাকে নিয়ে গর্ব করবে। আর সবশেষে আমি নিজেকে নিয়ে গর্ব করতে পারব। আর আমি সেটা করতে পেরেছি।

ক্রিকফ্রেঞ্জিঃ বিগ ব্যাশ আপনাকে বিভিন্ন কন্ডিশনে পারফর্ম করার জন্য সাহায্য করছে কী?

লামিচানেঃ হ্যাঁ, অবশ্যই। আপনি বিভিন্ন লীগে খেললে নিজের ক্রিকেটে উন্নতি আনতে পারবেন। আর অস্ট্রেলিয়ায় খেলা অন্য যে কোন দেশে খেলা থেকে ভিন্ন। কারণ উইকেটে কোন টার্ন থাকে না, অনেকটা স্কিডি থাকে। আপনাকে খুবই সতর্ক হতে হবে সেখানে পারফর্ম করার জন্য। ব্যাটসম্যান প্রতি বলেই আপনাকে ছয় মারবে, এই ভাবনা থেকেই আপনাকে প্রতিটি বল করতে হবে। এশিয়ান কন্ডিশনে বোলারদের জন্য সাহায্য থাকে। কারণ এখানে টার্ন থাকে, উইকেট থেকে সাহায্য পাওয়া যায়। অস্ট্রেলিয়ায় সেটা সম্ভব না।

ক্রিকফ্রেঞ্জিঃ অস্ট্রেলিয়ায় ভালো করলে আত্মবিশ্বাস বাড়ার কথা, বিশেষ করে স্পিনারদের ক্ষেত্রে...

লামিচানেঃ হ্যাঁ অবশ্যই, স্পিনার হিসেবে অস্ট্রেলিয়ায় ভালো করতে পারা আপনাকে অনেক আত্মবিশ্বাস দিবে। সামনে আরও ভালো করার জন্য এই আত্মবিশ্বাস জরুরী। 

ক্রিকফ্রেঞ্জিঃ বিগ ব্যাশ ছেড়ে আসার সিদ্ধান্তটা কতোটা কঠিন ছিল?

লামিচানেঃ বিগ ব্যাশ ও বিপিএলের সাথে আমার চুক্তি ছিল। আমি বিপিএলের সাথে চুক্তি করেছিলাম ১০-১২ মাস আগে। আমি বিগ ব্যাশকে বলেছিলাম আমার চুক্তির কথা। জানিয়েছিলাম আমি কবে থেকে কবে ফ্রি আছি। ওরা যদি চায় তাহলে এর মধ্যেই খেলতে পারব। নৈতিকতা থেকেই আমি বিপিএলে এসেছি। কারণ আমার কাছে আমার খারাপ সময়ে এসেছিল সিলেট সিক্সার্স।

ক্রিকফ্রেঞ্জিঃ লেগ স্পিনের শুরুটা কিভাবে?

লামিচানেঃ আমি বাড়ির সামনের রাস্তায় আমার ভাই, বন্ধুদের সাথে খেলতাম। আমি মিডিয়াম পেস, অফ স্পিন বল করতাম। আমি সব কিছুই চেষ্টা করেছি। কিন্তু তাদের আউট করতে কষ্ট হত আমার। এরপর আমি লেগ স্পিন বোলিং শুরু করি। পরে দেখলাম ওরা সবাই লেগ স্পিনের বিপক্ষে ধুঁকছে। আমি সহজেই তাদের পরাজিত করতে পারতাম লেগ স্পিন দিয়ে। এভাবেই সব কিছুর শুরু।

ক্রিকফ্রেঞ্জিঃ লেগ স্পিন শুরুর আগে আপনার অনুপ্রেরণা কে ছিল?

লামিচানেঃ সত্যি কথা বলতে আমি কাউকে দেখে লেগ স্পিন শুরু করি নি। কারণ আমাদের বাসায় টিভি ছিল না। আমরা ধারাভাষ্য শুনতাম, রেডিওতে। এরপর টিভি আসার পর আমি শেন ওয়ার্ন লেগ স্পিন করে দেখতাম। আমি শেন ওয়ার্নকে দেখেই লেগ স্পিন দিয়ে ক্যারিয়ার গড়ার স্বপ্ন দেখেছি। মোবাইল পাওয়ার পর আমি মোবাইলেও তাঁকে দেখতাম। 

ক্রিকফ্রেঞ্জিঃ আপনার ক্যারিয়ারে মাইকেল ক্লার্কের অবদান কেমন ছিল?

লামিচানেঃ সত্যি কথা বলতে, ওর বড় অবদান রয়েছে আমার ক্যারিয়ারে। কারণ নেপালের একটি ছেলে, যার জীবনে কিছুই ছিল না, তাঁকে সিডনিতে ডেকে নিয়েছেন তিনি। আমি তাঁর ক্লাবের হয়ে খেলেছি। ভালো পারফর্ম করেছি। নেপালের একটি ছেলে, যে এত কিছু পাচ্ছে এবং সব কিছুই ফ্রি, আমার স্পন্সররাও এসেছে তাঁর কারণে। আমি মনে করি অস্ট্রেলিয়ায় খেলার ওই সুযোগটা অনেক বড় ব্যাপার ছিল আমার জন্য। 

ক্রিকফ্রেঞ্জিঃ মাইকেল ক্লার্ক আপনাকে চিঠি লিখেছিল, অনুভূতি কেমন ছিল সেই সময়ের?

লামিচানেঃ আমার জন্য অবাক করার মত ছিল। ‘মাইকেল ক্লার্ক আমাকে ডেকেছে, আসলেই কী সত্যি?’ আমার অনুভূতি অনেকটা এমন ছিল। তবে আমি কিছুটা ইঙ্গিত আগে থেকেই পেয়েছিলাম, হংকং টি-টুয়েন্টিতে খেলার পর। আমাদের মধ্যে যোগাযোগ ছিল। তিনি আমাকে ইঙ্গিত দিয়েছিলেন এমন কিছুর। তবে যখন আমি খবর শেষ পর্যন্ত পেয়েছিলাম, তখন যথেষ্ট অবাক হয়েছিলাম। 

ক্রিকফ্রেঞ্জিঃ আইপিএলে দিল্লি ক্যাপিটালের হয়ে খেলার অভিজ্ঞতা কেমন ছিল?

লামিচানেঃ আমি খুবই ভাগ্যবান আইপিএলে খেলতে পেরে। দারুণ সব মানুষের সাথে আমার পরিচয় হয়েছে এর মাধ্যমে। দারুণ টুর্নামেন্ট আইপিএল। এর আগে আমি কখনো কোনো টি-টুয়েন্টি টুর্নামেন্টে খেলি নি। কোন টি-টুয়েন্টি ম্যাচও খেলিনি এর আগে। প্রথমবারের মত আইপিএলে আসা, এটা আমার জন্য আমার দেশ নেপালের জন্য গর্বের মুহূর্ত ছিল। নেপালের ছেলে, দেশের বাইরে গিয়ে আইপিএলের মত টুর্নামেন্টে খেলছে। শেষ তিন ম্যাচে খেলেছিলাম, ভালো পারফর্ম করেছিলাম। 

ক্রিকফ্রেঞ্জিঃ বিপিএলে আপনার দল সিলেট সিক্সার্সে আছেন আরেক লেগ স্পিনার ইমরান তাহির। তাঁর সাথে আপনার যোগাযোগ কেমন?

লামিচানেঃ হ্যাঁ, তাহির দারুণ একজন মানুষ। একদম মাটির মানুষের মতন তিনি। আমরা অনুশীলনে একজন আরেকজনের সাথে আলাপ করে অনুশীলন করে থাকি। একজন আরেকজনের সাথে তথ্য আদান প্রদান করি। 

ক্রিকফ্রেঞ্জিঃ সাম্প্রতিক সময়ে লেগ স্পিনের চাহিদা বাড়ছে কেন?

লামিচানেঃ সঠিক কারণ আমার জানা নেই। তবে আমার মনে হয় আপনি ভালো জায়গায় বল করলে কেউই মারতে পারবে না। আর লেগ স্পিন দিয়ে আপনি ব্যাটসম্যানকে বোকা বানাতে পারবেন। 

ক্রিকফ্রেঞ্জিঃ লেগ স্পিনার হিসেবে আপনার প্রধান অস্ত্র কী, আপনার গতি নাকি বৈচিত্র্য?

লামিচানেঃ আমি বলবো দুটিই। আমি আগে কম গতিতে বল করতাম। গত দুই বছর ধরে আমি ভালো গতিতে বল করছি। একই সাথে বোলিংয়ে অনেক বৈচিত্র্য আনার চেষ্টা করছি। আমি মনে করি গতি ও বৈচিত্র্য আমার বোলিংয়ে ভালো করার কারণ। 

ক্রিকফ্রেঞ্জিঃ রাশিদ খান কী পথ দেখাচ্ছে বিশ্বের বাকি লেগ স্পিনারদের, কারণ তিনিও অনেক জোরে বল করেন।

লামিচানেঃ হ্যাঁ অবশ্যই। রাশিদ লেগ স্পিনের সংজ্ঞাই বদলে দিয়েছে। ২০০০ সালে ক্রিকেট এক রকম ছিল, ২০১৯ সালের ক্রিকেট আবার সম্পূর্ণ ব্যতিক্রম। তখন খুব কম ব্যাটসম্যান ছিল যারা সুইপ শট খেলত। তখন বোলাররা পায়ের আশে পাশে বল করতে পারত। এখন আপনাকে অনেক সতর্ক হতে হবে। আপনাকে ভালো গতিতে বল করতে হবে, গতিতে বৈচিত্র্য আনতে হবে। আমি মনে করি রাশিদ লেগ স্পিনের এই যুগে বড় পরিবর্তন এনে দিয়েছে। এখন অনেক তরুণ বোলার তাঁকে অনুসরন করছে। 

ক্রিকফ্রেঞ্জিঃ নেপাল ফিরে গেলে আপনাকে স্থানীয়রা কিভাবে গ্রহন করে, আগের সেই বালক হিসেবে নাকি তারকা হিসেবে?

লামিচানেঃ না তেমন কিছু না। আপনি এটার স্বপ্নই তো দেখেন। মানুষ আপনাকে অনুকরণ করবে, আপনার মত হতে চাইবে। এই ভালোবাসা তো আপনি প্রত্যাশা করবেন। কিন্তু এখন আগের মত সহজে চলাফেরা করার সুযোগ হয় না। আগে আমি যে কোন জায়গায় ঘুরতে যেতে পারতাম। এখন সেটা হয় না, একা চলাফেরা করা যায় না। আমি আমার শহরে সহজে চলাফেরা করতে পারব। কিন্তু রাজধানী বা বড় শহরের মানুষ জন দেখা করতে চায়, অভিজ্ঞতা শেয়ার করতে চায়। 

ক্রিকফ্রেঞ্জিঃ নেপাল ক্রিকেটের বর্তমান অবস্থাকে কিভাবে দেখছেন?

লামিচানেঃ আমরা চার বছর আগে যেখানে ছিলাম, এখন সেখানেই আছি। আমরা ২০১৪ টি-টুয়েন্টি বিশ্বকাপের বাছাইপর্ব খেলেছিলাম বাংলাদেশে। এরপর নেপাল ক্রিকেট হারিয়ে যায়। আমি আমার অভিষেক করেছিলাম যেই দিন, সেদিনই আইসিসি নেপাল ক্রিকেটকে নিষিদ্ধ করে। আশা করি দ্রুত সব সমস্যার সমাধান হবে, আমাদের যদি ঘরোয়া ক্রিকেট কাঠামো ভালো থাকে তাহলে নেপালকে আরও ভালো করতে দেখবেন।