ক্রিকেট লেজেন্ডস

জর্জ হেডলিঃ দ্য ব্ল্যাক ব্র্যাডম্যান

ক্রিকফ্রেঞ্জি করেসপন্ডেন্ট

ক্রিকফ্রেঞ্জি করেসপন্ডেন্ট
প্রকাশের তারিখ: 11:12 রবিবার, 06 জানুয়ারি, 2019

|| ফ্রাইডে স্পেশাল ||

বিশ এবং ত্রিশের দশকের ওয়েস্ট ইন্ডিজ দলটা ছিল বেশ দুর্বল এবং অনভিজ্ঞ। অথচ সেই দুর্বল সাদামাটা একটা দল নিয়েই অস্ট্রেলিয়া-ইংল্যান্ডের মত ক্রিকেট পরাশক্তির সাথে টেক্কা দিতেন একজন। তিনি হলেন  টেস্ট ইতিহাসের প্রথম কৃষ্ণাঙ্গ গ্রেট, ক্যারিবিয়ান ক্রিকেটের প্রথম 'সুপারস্টার' জর্জ আলফনসো হেডলি। অবিশ্বাস্য রান স্কোরিং এবিলিটির কারণে যাকে তুলনা করা হত স্যার ডন ব্র্যাডম্যানের সাথে; আদর করে ডাকা হত 'ব্ল্যাক ব্র্যাডম্যান নামে'!

সমসাময়িক ক্রীড়া বিশ্লেষকদের প্রায় সবাই ব্র্যাডম্যানের পর জর্জ হেডলিকেই একবাক্যে 'দ্বিতীয় সেরা' বলে মেনে নিয়েছেন। এমনকি ইংরেজ কিংবদন্তি ওয়ালি হ্যামন্ডের চাইতেও হেডলিকে এগিয়ে রাখতেন অনেকে।

ব্যাটসম্যান হিসেবে জর্জ হেডলির অবস্থান সর্বকালের সেরাদের কাতারে, এ নিয়ে কোন সন্দেহ নেই। এমনকি ইতিহাসের সবচাইতে ইমপ্যাক্টফুল ক্রিকেটারদের তালিকায়ও হেডলির নামটা ওপরের দিকেই থাকবে। অভিষেকের পর থেকেই ক্যারিবীয় ক্রিকেটে হেডলির ইমপ্যাক্ট ছিল সুদূরপ্রসারী এবং তাৎক্ষণিক। তাঁর ডাকনাম ছিল 'অ্যাটলাস'। যার বাংলা অর্থ করলে দাঁড়ায় 'ভারবাহক'। দলের সেরা ব্যাটসম্যান হেডলিও যাবতীয় প্রত্যাশার ভার বয়ে বেড়াতেন নিজের কাঁধে। এককথায় ওয়েস্ট ইন্ডিজ ক্রিকেটের মেরুদণ্ড ছিলেন জর্জ হেডলি।

হেডলির ওপর উইন্ডিজ ঠিক কতটা নির্ভরশীল ছিল তা বোঝানোর জন্য একটা পরিসংখ্যান দিচ্ছি। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের আগে টেস্টে ওয়েস্ট ইন্ডিজের মোট দলীয় রানের ২৬.৫ শতাংশই এসেছিল জর্জ হেডলির ব্যাট থেকে! হেডলির ব্যাটিং গড় ছিল যেখানে ৬৬.৭১, সেখানে দ্বিতীয় স্থানে থাকা ওপেনার ক্লিফোর্ড রোচের গড় ছিল ৩০.৭০, বাকিদের পঁচিশের নিচে! ওয়েস্ট ইন্ডিয়ান ব্যাটসম্যানদের হাঁকানো ১৫টা টেস্ট সেঞ্চুরির ১০টাই ছিল জর্জ হেডলির! 

মাইকেল হোল্ডিংয়ের মতে, “George Headley was a clear cut example in cricket history of a man single handedly carrying his side."

ইতিহাসবিদ সি.এল.আর জেমসের ভাষায়, "No other great batsman had to carry such a burden for so long."

এবারে জর্জ হেডলির ব্যাটিং স্টাইল এবং টেকনিক নিয়ে কিছু বলা যাক। ন্যাচারাল ব্যাকফুট প্লেয়ার হেডলির দৃষ্টিশক্তি ছিল অত্যন্ত প্রখর। ফুটওয়ার্ক ছিল ক্ষিপ্র এবং চনমনে। যেকোন শটে প্রচুর পাওয়ার জেনারেট করতে পারতেন, টাইমিং এবং প্লেসমেন্ট হত নিখুঁত। হুক, স্কয়ার কাট আর লেট কাটে ছিলেন দুর্দান্ত। তাঁর সবচেয়ে প্রিয় এবং কার্যকরী শট ছিল ব্যাকফুট অন ড্রাইভ।

উইজডেনের চোখে, “Exceptionally quick on his feet, he watched the ball onto the bat more than any other batsman.”

স্যার ডন ব্র্যাডম্যানের ভাষায়, “He was strong in every direction, moved his feet very quickly, splendid in his defence. He had full range of strokes, an exceptional hook shot, was particularly strong on the on side. I rate George Headley very highly indeed.”

টনি কোজিয়ারের ভাষায়, “Small and compact, like all great players Headley was excellent off the back-foot, but was also blessed with incredible footwork to get to the pitch of the ball when required. He saw every ball early, out of the hand of the bowler, and revelled in playing as late as possible.”

ইতিহাসবিদ ডেভিড ফ্রিথের ভাষায়, “He was very wristy, attractive, probably more graceful than Bradman, stylish and effective.”

জর্জ হেডলি ছিলেন স্টিকি উইকেটের মাস্টার। বৃষ্টিভেজা পিচে অন্য ব্যাটসম্যানদের যেখানে রানের জন্য সংগ্রাম করতে হতো, সেখানে হেডলি ছিলেন আশ্চর্যরকমের সাবলীল। এমনকি রেকর্ড-পরিসংখ্যানও তাঁর হয়েই কথা বলছে। সমসাময়িকদের ক্রিকেট বিশ্লেষকদের বেশিরভাগের মতে ভেজা উইকেটে সম্ভবত হেডলিই সর্বকালের সেরা। ভুলে গেলে চলবে না, তাদের অনেকেই ভেজা উইকেটে স্যার জ্যাক হবস, ভিক্টর ট্রাম্পার, ওয়ালি হ্যামন্ডদের খেলাও দেখেছেন। তবুও তাঁরা হেডলিকে সেরা হিসেবে মেনে নিয়েছেন।

ইতিহাসবিদ সি.এল.আর জেমস একবার ভেজা উইকেটে ব্যাটসম্যানদের পরিসংখ্যান বের করেছিলেন। সেখানে দেখা যায়, বৃষ্টিভেজা পিচে ১৩ ইনিংসে মোট ৭ বার ফিফটির দেখা পেয়েছেন জর্জ হেডলি; ব্যাটিং গড় ৩৯.৮৫! অথচ একই কন্ডিশনে ব্র্যাডম্যানের গড় মাত্র ১৬.৬৬! ১৫ ইনিংসে ফিফটি হাঁকিয়েছেন মাত্র ১টা!

স্বনামধন্য ক্রীড়াসাংবাদিক গিডিওন হেইয়ের মতে, “ওয়েস্ট ইন্ডিজের ইতিহাসে যত ব্যাটসম্যান এসেছেন, তাঁদের প্রত্যেকের শ্রেষ্ঠত্ব বা গ্রেটনেসের মাপকাঠি হলেন জর্জ হেডলি।”

জর্জ হেডলির জন্ম ও বেড়ে ওঠা পানামায়। তাঁর মাতৃভাষা ছিল স্প্যানিশ। ঐতিহাসিক পানামা খালের অবকাঠামো নির্মাণের কাজে নিয়োজিত ছিলেন জর্জের বাবা ডিকোর্সি হেডলি। ১০ বছর বয়সে তিনি মায়ের সাথে পাড়ি জমান জ্যামাইকায়, ভর্তি হন একটি ইংরেজি মাধ্যমের স্কুলে। ক্রিকেটের সাথে প্রথম পরিচয় ঘটে সেখানেই। একসময় ক্রিকেটই হয়ে ওঠে তাঁর ধ্যানজ্ঞান, ক্রিকেটেই গড়েন বসতি।

প্রথম শ্রেণির ক্রিকেটে হেডলির অভিষেক মাত্র ১৮ বছর বয়সে; জ্যামাইকা সফররত লর্ড টেনিসন'স একাদশের বিপক্ষে। একই প্রতিপক্ষের বিপক্ষে ক্যারিয়ারের মাত্র দ্বিতীয়
ফার্স্ট ক্লাস ম্যাচেই হাঁকান ডাবল সেঞ্চুরি (২১১)। যে ইনিংস দেখে মুগ্ধ হয়ে তাঁকে অস্ট্রেলিয়ান কিংবদন্তি ভিক্টর ট্রাম্পারের সাথে তুলনা করেছিলেন স্বয়ং লর্ড টেনিসন। ওই ইনিংসটি খেলার পথে এক পর্যায়ে নাকি টানা তিন ওভারে ১৩টা বাউন্ডারি মেরেছিলেন হেডলি! তিন ম্যাচের সিরিজে ৮১.৮০ গড়ে হেডলির ব্যাট থেকে এসেছিল ৪০৯ রান। 

দুর্দান্ত ফর্মে থাকা সত্ত্বেও ১৯২৮ সালে ইংল্যান্ডের বিপক্ষে ওয়েস্ট ইন্ডিজের প্রথম আন্তর্জাতিক সফরের দলে জায়গা পান নি জর্জ হেডলি। টেস্ট অভিষেকের জন্য তাঁকে অপেক্ষা করতে হয়েছে আরও দু’বছর।

১৯২৯ সালে জুলিয়ান কানের নেতৃত্বে ইংল্যান্ড থেকে আরও একটি দল এসেছিল জ্যামাইকায়। যে দলে ছিলেন স্ট্যান নিকোলস, নবি ক্লার্ক, জ্যাক মার্সার, এওয়ার্ট আস্তিলের মত কাউন্টি স্টাররা। সেই দলের বিপক্ষেও ৫৭ এবং ১৪৩ রানের চমৎকার দুটো ইনিংস খেলেছিলেন সদ্য টিনেজ পেরোনো জর্জ হেডলি।

১৯৩০ সালের ১১ জানুয়ারি, বারবাডোজের কেনসিংটন ওভালে ইংল্যান্ডের বিরুদ্ধে হেডলির টেস্ট অভিষেক। দু'বছর আগের 'উপেক্ষিত' হেডলি এবারে ছিলেন অটোমেটিক চয়েস। নির্বাচকদের উপেক্ষার জবাবটাও দিয়েছিলেন একেবারে হাতেনাতে। প্রথম' ক্যারিবীয় ব্যাটসম্যান হিসেবে টেস্ট অভিষেকেই হাঁকান সেঞ্চুরি। হেডলির দুর্দান্ত শতকের (১৭৬) কল্যাণেই নিজেদের ইতিহাসে প্রথমবারের মত টেস্ট ম্যাচ 'ড্র' করতে সমর্থ হয় উইন্ডিজ।

এর পরের টেস্টটা হয়েছিল ত্রিনিদাদে। সে ম্যাচে তেমন একটা রান (৩৯ ও ৮) না পেলেও ঘুরে দাঁড়ান গায়ানার জর্জটাউনে সিরিজের তৃতীয় টেস্টে। উপহার দেন জোড়া সেঞ্চুরি (১১৪ ও ১১২); ওয়েস্ট ইন্ডিজের ইতিহাসে প্রথম ব্যাটসম্যান হিসেবে এই কীর্তি গড়েন তিনি। জর্জ হেডলির অনবদ্য জোড়া শতকে ভর করেই ইংল্যান্ডকে ২৮৯ রানের বিশাল ব্যবধানে হারায় ওয়েস্ট ইন্ডিজ। উল্লেখ্য, এটা ছিল উইন্ডিজের ইতিহাসে প্রথম টেস্ট জয় যার নায়ক ছিলেন জর্জ হেডলি।

জ্যামাইকার কিংস্টনে সিরিজের চতুর্থ এবং শেষ টেস্টে আবারও হেডলির চমক! চতুর্থ ইনিংসে ওয়েস্ট ইন্ডিজের সামনে জয়ের লক্ষ্যমাত্রা দাঁড়িয়েছিল ৮৩৬ রান! অসম্ভব সেই লক্ষ্য তাড়া করতে নেমে ওয়েস্ট ইন্ডিজ করেছিল ৫ উইকেটে ৪০৮ রান। দুদলের অধিনায়কের সম্মতিক্রমে শেষ পর্যন্ত 'ড্র' মেনে নিয়েছিল সবাই। তিন নম্বরে নেমে ৩৮৫ বলে ২২৩ রানের দুর্দান্ত এক ইনিংস খেলেন জর্জ হেডলি। টেস্টের চতুর্থ ইনিংসে ব্যক্তিগত সর্বোচ্চ রানের রেকর্ড হিসেবে যে কীর্তি টিকে আছে আজও!

চার ম্যাচের সিরিজটা শেষ হয়েছিল ১-১ সমতায়। অভিষেক সিরিজেই ব্যাট হাতে নিজের জাত চেনানো কুড়ি বছরের তরুণ জর্জ হেডলি করেছিলেন ৪ সেঞ্চুরিসহ ৭০৩ রান, ৮৭.৮৭ গড়ে! বিল ভোস, উইলফ্রেড রোডস, এওয়ার্ট আস্তিল, নাইজেল হেগের মত বোলাররাও আটকাতে পারেন নি তাঁকে।

১৯৩১ সালে প্রথমবারের মত পূর্ণাঙ্গ সিরিজ খেলতে অস্ট্রেলিয়া সফরে গিয়েছিল জ্যাকি গ্রান্টের নেতৃত্বাধীন ওয়েস্ট ইন্ডিজ। 'শক্তিশালী' অস্ট্রেলিয়ার বিরুদ্ধে পেরে না উঠলেও সাহসী ও নান্দনিক ব্যাটিংশৈলী দিয়ে ঠিকই দর্শক-সমালোচক সবার মন জয় করে নিয়েছিলেন জর্জ হেডলি। সিরিজে ক্যারিবীয়দের একমাত্র জয়টাও এসেছিল হেডলির ব্যাটিং বীরত্বেই।

সফর শুরু করেছিলেন নিউ সাউথ ওয়েলসের বিপক্ষে ৩১ ও ৮২ রানের দুটো ইনিংস দিয়ে। ভিক্টোরিয়ার বিপক্ষে পরের ম্যাচেই হাঁকান দুর্দান্ত এক শতক। উইন্ডিজের দলীয় স্কোর ১৯৩ রানের ১৩১-ই এসেছিল হেডলির ব্যাট থেকে। অস্ট্রেলিয়ার সাবেক অফ স্পিনার হিউ ট্রাম্বলের চোখে যেটা ছিল, “The best hundred I've ever seen."

ওই ম্যাচে হেডলিকে খুব কাছ থেকে দেখেছিলেন ভিক্টোরিয়ার অধিনায়ক বিল উডফুল। তিনি একটা ব্যাপার খেয়াল করলেন যে, জর্জ হেডলি অফ সাইডে যতটা স্বচ্ছন্দ, অন সাইডে ততটা নন। অন সাইডে তাঁর শটের রেঞ্জও সীমিত। সাউথ অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে পরের ম্যাচে সেটা কাজে লাগাতে চাইলেন ক্ল্যারি গ্রিমেটসহ অন্য বোলাররাও। হেডলির লেগ স্টাম্প লক্ষ্য করে আক্রমণাত্মক বোলিং এবং ফিল্ডিং সাজিয়ে তৈরি করা হয় 'লেগ ট্র্যাপ'। ফলাফল দুই ইনিংসে মাত্র ২৭ এবং ১৬ রানের বেশি করতে পারেন নি হেডলি।

হেডলিকে থামাতে অভিনব এই কৌশল কাজ করেছিল টনিকের মত। যার নেতৃত্বে ছিলেন লেগ স্পিন কিংবদন্তি ক্ল্যারি গ্রিমেট। সিরিজের প্রথম দুই টেস্টে তিনবার গ্রিমেটের স্কিল এবং ট্যাক্টিকাল বুদ্ধিমত্তার কাছে হার মানতে বাধ্য হন হেডলি। ওই দুই টেস্টের চার ইনিংসে তাঁর সংগ্রহ ছিল যথাক্রমে ০, ১১, ১৪ এবং ২ রান! যথারীতি ওয়েস্ট ইন্ডিজ দলও হেরেছিল শোচনীয়ভাবে।

তবে ব্রিসবেনে তৃতীয় টেস্টেই দেখা গেল ভিন্ন চিত্র। বয়সে তরুণ হেডলি সাময়িকভাবে কিছুটা অস্বস্তিতে ভুগলেও এই টেস্ট দিয়ে ফিরে আসেন দারুণভাবে। ক্ল্যারি গ্রিমেট-বার্ট আয়রনমঙ্গারদের 'লেগ ট্র্যাপ' উপেক্ষা করে তিনি উপহার দেন ১১ বাউন্ডারিতে সাজানো অপরাজিত ১০২ রানের স্ট্রোক ঝলমলে এক ইনিংস; খেলেন দুর্দান্ত সব অন ড্রাইভ, গ্লান্স, ফ্লিক আর পুল শট। নিজের দুর্বলতাকে কীভাবে শক্তিমত্তায় পরিণত করতে হয়, সেটাই যেন হাতে-কলমে শিখিয়েছিলেন তিনি। তবে অমন দুর্দান্ত একটা ইনিংসের পরও ম্যাচটা ইনিংস ব্যবধানে হেরেছিল উইন্ডিজ।

ব্রিসবেনে হেডলির সেঞ্চুরিটা ছিল নিঃসন্দেহে একটি মাস্টারক্লাস। অস্ট্রেলিয়ান বোলারদের লেগ ট্র্যাপ মোকাবিলায় নিজের ব্যাটিং স্টান্স পর্যন্ত বদলে ফেলেছিলেন তিনি! উইজডেনের ভাষায়, “In an effort to overcome Australia's leg stump attack Headley had altered his batting stance instead of standing at right angles to the bowler, he turned his body more front-on, to enable him to improve his placement of the ball on the leg side. His quick footwork enabled him to alter his position if necessary to play the ball on the off side.”

মেলবোর্নে পরের টেস্টে আবার ব্যর্থ হলেও (৩৩ ও ১১) হেডলি সেঞ্চুরি পেয়েছিলেন সিডনিতে সিরিজের পঞ্চম এবং শেষ টেস্টে। যে ম্যাচে অস্ট্রেলিয়াকে ৩০ রানে হারিয়ে ইতিহাস রচনা করেছিল টানা চার ম্যাচ হেরে 'বিধ্বস্ত' ওয়েস্ট ইন্ডিজ। এ ম্যাচেও দলের 'ক্রাইসিস ম্যান' হয়ে ওঠা হেডলির ব্যাট থেকে এসেছিল ১০৫ ও ৩০ রানের 'মহামূল্যবান' দুটো ইনিংস।

পাঁচ ম্যাচের টেস্ট সিরিজে হেডলি করেছিলেন ৩৭.৩৩ গড়ে ৩৩৬ রান। আর সবগুলো ট্যুর ম্যাচ মিলিয়ে ৪৪.৪১ গড়ে ১০৬৬ রান।

ব্রিসবেন এবং সিডনি টেস্টে 'ক্ল্যাসিক' দুটো সেঞ্চুরি হাঁকানোর পর থেকেই জর্জ হেডলির নাম হয়ে যায় 'ব্ল্যাক ব্র্যাডম্যান'। অবশ্য অতি উৎসাহী জ্যামাইকানরা তাদের 'ঘরের ছেলে' জর্জ হেডলিকে এতটাই উঁচু আসনে বসিয়েছিল, যে ব্র্যাডম্যানকেই 'হোয়াইট হেডলি' নামে ডাকা আরম্ভ করেছিল! এটা অবশ্যই অতিরঞ্জন; তবে তা ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতেই দেখতেন সমসাময়িক ক্রিকেটবোদ্ধারা।

কেবল সাধারণ দর্শকই নন; হেডলির প্রশংসায় পঞ্চমুখ ছিলেন স্বয়ং ব্র্যাডম্যানসহ সিবি ফ্রাই, জনি ময়েস, হার্বার্ট কলিন্সের মত ক্রিকেট বিশেষজ্ঞরাও। হেডলির ব্যাটিং শৌর্যে মুগ্ধ হয়ে ক্ল্যারি গ্রিমেট তো বলেই বসেছিলেন, "The best on-side batsman I've ever played against". অথচ সিরিজের শুরুর দিকে হেডলিকে সবাই চিনত একজন ন্যাচারাল অফ সাইড প্লেয়ার হিসেবে!

১৯৩২ সালে দ্বিতীয়বারের মত জ্যামাইকা সফরে এসেছিল লর্ড টেনিসন'স একাদশ। ক্যারিয়ার সেরা ৩৪৪* রানের 'মহাকাব্যিক' এক ইনিংস খেলে তাদের স্বাগত জানিয়েছিলেন জর্জ হেডলি। তিন ম্যাচের সিরিজে হেডলির সংগ্রহ ছিল ৩৬১.৫ গড়ে ৭২৩ রান! চার ইনিংসের স্কোরগুলো ছিল যথাক্রমে ৩৪৪*, ৮৪, ১৫৫* এবং ১৪৩!

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের আগে ১৯৩৩, ১৯৩৫ এবং ১৯৩৯ সালে আরো তিনটি সিরিজ খেলেছিলেন জর্জ হেডলি; তিনটাতেই প্রতিপক্ষ ছিল ইংল্যান্ড।

১৯৩৩ সালের ইংল্যান্ড সফরে ওয়েস্ট ইন্ডিজ হেরেছিল ২-০ ব্যবধানে। হেডলির ব্যাট থেকে এসেছিল ৫৫.৪০ গড়ে ২৭৭ রান। আর ফার্স্ট ক্লাস ট্যুর ম্যাচগুলোতে তাঁর সংগ্রহ ছিল ৭ সেঞ্চুরিসহ ৬৬.২৮ গড়ে ২০২৩ রান।

উল্লেখ্য, হেডলির ব্যাটিং নৈপুণ্যেই ওল্ড ট্র্যাফোর্ডে সিরিজের দ্বিতীয় টেস্টটা ড্র করতে সমর্থ হয়েছিল ক্যারিবীয়রা। ১৮ বাউন্ডারিতে সাজানো জর্জ হেডলির ৩৭৫ বলে অপরাজিত ১৬৯ রানের ইনিংসটা ছিল ইংল্যান্ডের মাটিতে কোন ক্যারিবীয় ব্যাটসম্যানের প্রথম টেস্ট সেঞ্চুরি। দুর্দান্ত সেই 'ম্যাচ সেভিং' ইনিংসের বর্ণনায় উইজডেন লিখেছিল, “A magnificent innings, displaying a ready adaptability and perfection of timing."

ব্যাট হাতে দুর্দান্ত একটা মৌসুম কাটানোর পুরস্কার হিসেবে ১৯৩৪ সালে তিনি জিতে নেন উইজডেন মনোনীত বর্ষসেরা ক্রিকেটারের খেতাব।

১৯৩৫ সালে ইংল্যান্ডের বিপক্ষে চার ম্যাচের হোম সিরিজটা ২-১ ব্যবধানে জিতে নেয় ওয়েস্ট ইন্ডিজ। উল্লেখ্য, এটাই ছিল ওয়েস্ট ইন্ডিজের ইতিহাসে প্রথম টেস্ট সিরিজ জয়ের কীর্তি! ব্যাট হাতে ফর্মের তুঙ্গে থাকা জর্জ হেডলির উইলো থেকে এসেছিল ৯৭.০ গড়ে সিরিজ সর্বোচ্চ ৪৮৫ রান। জ্যামাইকায় সিরিজের শেষ টেস্টে তুলে নিয়েছিলেন ক্যারিয়ারের দ্বিতীয় ডাবল সেঞ্চুরি (২৭০*)। ম্যাচের ভাগ্য গড়ে দেয়া অনবদ্য সেই ইনিংসটা ছিল একই সাথে 'ম্যাচ' এবং 'সিরিজ' নির্ধারণী।

ওই একটা ইনিংস দিয়েই জ্যামাইকা তথা সমগ্র ক্যারিবীয় দ্বীপপুঞ্জের অধিবাসীদের কাছে জাতীয় বীরের মর্যাদা পেয়েছিলেন হেডলি। উইজডেনের ভাষায়, “And their spearhead, George Headley became a folk legend."

উল্লেখ্য, হেডলির ২৭০* ছিল তখনও পর্যন্ত টেস্টে কোন ওয়েস্ট ইন্ডিয়ান ব্যাটসম্যানের সর্বোচ্চ স্কোর। যে রেকর্ডটা পরে ভেঙেছিলেন স্যার গ্যারি সোবার্স (৩৬৫)।

ওয়েস্ট ইন্ডিজের পরবর্তী ইংল্যান্ড সফরটা ছিল চার বছর পর; ১৯৩৯ সালে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের আগে জর্জ হেডলির শেষ সিরিজ। সিরিজে হেডলির শুরুটা হয়েছিল দুর্দান্ত। ইতিহাসের প্রথম ব্যাটসম্যান হিসেবে গড়েন লর্ডসের মাটিতে জোড়া সেঞ্চুরি হাঁকানোর কীর্তি!

উইজডেনের ভাষায়, “At Lord’s Headley demonstrated his exceptional class, negotiating Bill Bowes, Hedley Verity and Doug Wright to score 106 and 107.”

দুঃখের বিষয় হল, এর পরেও ওয়েস্ট ইন্ডিজ ম্যাচটা হেরেছিল ৮ উইকেটের ব্যবধানে। উল্লেখ্য, হার্বার্ট সাটক্লিফের পর জর্জ হেডলিই ছিলেন টেস্টে একাধিক 'জোড়া সেঞ্চুরি' হাঁকানো প্রথম ব্যাটসম্যান।

ব্যাট হাতে হেডলির দুরন্ত ফর্ম বজায় ছিল ট্যুর ম্যাচগুলোতেও। নটিংহ্যামশায়ারের বিপক্ষে ২৩৪ রানে করার পর ইয়র্কশায়ারের বিপক্ষে ভেজা, আনকভার্ড, 'আনপ্লেয়েবল' স্টিকি উইকেটে খেলেন ৬১ রানের অনবদ্য ইনিংস। যে ইনিংসটিকে 'স্টিকি উইকেটে' নিজের দেখা সেরা ইনিংস হিসেবে আখ্যায়িত করেছিলেন প্রখ্যাত ক্রীড়ালেখক নেভিল কার্ডাস।

পরের দুটো টেস্ট ড্র হলে শেষমেশ ১-০ ব্যবধানে সিরিজ জিতে নেয় স্বাগতিক ইংল্যান্ড। ৬৬.৮০ গড়ে ৩৩৪ রান করেন জর্জ হেডলি। আর ফার্স্ট ক্লাস মর্যাদাসম্পন্ন ট্যুর ম্যাচগুলোতে তাঁর সংগ্রহ ছিল ৭২.৭০ গড়ে ১৭৪৩ রান!

এরপরই শুরু হয় দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ। স্যার ডন ব্র্যাডম্যানের মত জর্জ হেডলির ক্যারিয়ার থেকেও হারিয়ে যায় মূল্যবান আটটি বছর! আবার যখন ফিরলেন, চল্লিশ ছুঁইছুঁই হেডলি তখন বয়সের ভারে ন্যুব্জ। হেডলির আগের সেই চিরচেনা 'ক্যারিশম্যাটিক' রূপটা আর কখনই দেখা যায় নি। নিজের সেরা সময়টা যে ফেলে এসেছেন অনেক আগেই!

জর্জ হেডলির ক্যারিয়ারটাকে দুই ভাগে ভাগ করা যেতে পারে। বিশ্বযুদ্ধের আগে এবং পরে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের আগে ১৯ টেস্টে হেডলির সংগ্রহ ছিল ১০ সেঞ্চুরি ও ৫ ফিফটিতে ২১৩৫ রান, ৬৬.৭১ গড়ে! সেসময় হেডলির চাইতে বেশি গড় ছিল শুধুমাত্র ব্র্যাডম্যানের (৯৭.৯৪)।

বিশ্বযুদ্ধ পরবর্তী যুগে হেডলি খেলেছেন মাত্র ৩ টেস্ট; ৫৫ রান করেছেন মাত্র ১১ গড়ে!

১৯৪৮ সালে ইংল্যান্ডের বিপক্ষে প্রত্যাবর্তন টেস্টে হেডলি করেছিলেন মাত্র ২৯ এবং ৭ রান। একই বছর নভেম্বরে ইতিহাসে প্রথমবারের মত ভারত সফরে যায় ওয়েস্ট ইন্ডিজ। দলের অধিনায়ক মনোনীত করা হয় জর্জ হেডলিকে। দিল্লিতে অনুষ্ঠিত সিরিজের একমাত্র টেস্টে তাঁর সংগ্রহ ছিল মাত্র ২ রান!

উল্লেখ্য, টেস্ট ইতিহাসের প্রথম কৃষ্ণাঙ্গ অধিনায়ক হলেন জর্জ হেডলি। অনেকের মতে, পর্যাপ্ত সুযোগ পেলে হেডলি অধিনায়ক হিসেবেও হতে পারতেন কিংবদন্তি। কিন্তু দেশকে নেতৃত্ব দেয়ার সেই সুযোগটাই পান নি তিনি। এ নিয়ে আক্ষেপও করেছেন অনেকে। ক্রিকেটের খুঁটিনাটি বিষয়ে হেডলির ছিল অগাধ পান্ডিত্য, ট্যাকটিকাল সেন্স ও বুদ্ধিমত্তা ছিল তুখোড়, পর্যবেক্ষণ ক্ষমতা ছিল অসাধারণ।

জর্জ হেডলির টেস্ট ক্যারিয়ার কার্যত তখনই শেষ। ১৯৪৮-১৯৫৩ পর্যন্ত টানা ৫ বছর আন্তর্জাতিক ক্রিকেট থেকে দূরে ছিলেন তিনি। ১৯৫০ সালে বার্মিংহাম লীগ খেলতে চলে যান ইংল্যান্ডে। অবশেষে ১৯৫৪ সালে প্রবল গণদাবীর মুখে বিদায়ী টেস্ট খেলতে আবারও জ্যামাইকায় ফেরানো হয় তাঁকে। প্রতিপক্ষ সেই ইংল্যান্ড! ক্যারিয়ারের শেষ ইনিংসে তিনি নেমেছিলেন ৬ নম্বরে; বাঁহাতি স্পিনার টনি লকের ঘূর্ণিতে বোল্ড হওয়ার আগে করতে পেরেছিলেন মাত্র ১৬ রান।

খেলোয়াড়ি জীবন শেষে কিছুদিন কোচিংয়ের সাথেও জড়িত ছিলেন জর্জ হেডলি। ১৯৫৫ সাল থেকে ১৯৬০ সাল পর্যন্ত জ্যামাইকার কোচের দায়িত্ব পালন করেছেন তিনি। তাঁর উল্লেখযোগ্য আবিষ্কার ছিল ব্যাটসম্যান ইস্টন ম্যাকমরিস এবং ফাস্ট বোলার রয় গিলক্রিস্ট। জেনে নিশ্চয়ই অবাক হবেন, ১৯৬১ সালে ছয় মাসের জন্য নাইজেরিয়া জাতীয় ক্রিকেট দলকেও কোচিং করিয়েছেন হেডলি।

চলুন এক নজরে দেখে নিই জর্জ হেডলির ক্যারিয়ার পরিসংখ্যান।

২৪ বছরের লম্বা ক্যারিয়ারে (১৯৩০-১৯৫৪) জর্জ হেডলি টেস্ট খেলেছেন মাত্র ২২টি। ব্যাট করেছেন ৪০ ইনিংসে, ৬০.৮৩ গড়ে তাঁর সংগ্রহ ২১৯০ রান। ১০টি সেঞ্চুরির পাশে ফিফটি ৫টি। ক্যারিয়ার সেরা ২৭০*, বিপক্ষ ইংল্যান্ড।

এছাড়া ১০৩টি প্রথম শ্রেণির ম্যাচে জর্জ হেডলির সংগ্রহ ৬৯.৮৬ গড়ে ৯৯২১ রান। ৩৩টি সেঞ্চুরির পাশে হাফ সেঞ্চুরি আছে ৪৪টি।

পূর্ণাঙ্গ ক্যারিয়ার শেষে টেস্ট ইতিহাসের তৃতীয় সেরা ব্যাটিং গড়ের অধিকারী ব্যাটসম্যান হলেন জর্জ হেডলি। প্রথম ও দ্বিতীয় স্থানে আছেন যথাক্রমে স্যার ডন ব্র্যাডম্যান (৯৯.৯৪) এবং গ্রায়েম পোলক (৬০.৯৭)।

ফার্স্ট ক্লাস ক্রিকেটে কমপক্ষে ৫০ ইনিংস খেলা ব্যাটসম্যানদের মধ্যে জর্জ হেডলির গড় (৬৯.৮৬) ইতিহাসে তৃতীয় সর্বোচ্চ। তাঁর উপরে আছেন শুধুমাত্র স্যার ডন ব্র্যাডম্যান (৯৫.১৪) এবং ভারতের বিজয় মার্চেন্ট (৭১.৬৪)।

টেস্টে ৪০ ইনিংসে হেডলির সেঞ্চুরি সংখ্যা ১০টি। অর্থাৎ গড়ে প্রতি চার ইনিংসে অন্তত একটি সেঞ্চুরি হাঁকিয়েছেন তিনি। ইনিংস প্রতি সেঞ্চুরি রেটে স্যার ডন ব্র্যাডম্যানের (২.৭৬) ঠিক পরই অবস্থান করছেন জর্জ হেডলি।

জর্জ হেডলি খেলেছেন এমন পাঁচটি ম্যাচে জয় পেয়েছে ওয়েস্ট ইন্ডিজ। এই পাঁচ টেস্টে তাঁর সংগ্রহ ৯৫.৭৫ গড়ে ৭৬৬ রান! দল জিতেছে এমন ম্যাচে কমপক্ষে ৭০০ রান করা ব্যাটসম্যানদের মধ্যে ব্যাটিং গড়ে সবার চেয়ে এগিয়ে আছেন স্যার ডন ব্র্যাডম্যান (১৩০ গড়ে ৪৮১৩ রান); জর্জ হেডলির অবস্থান দ্বিতীয়।

এবারে জেনে নেয়া যাক একটি অন্যরকম তথ্য। ক্রিকেটে পারিবারিক ঐতিহ্য ধরে রাখাটা মোটেও চাট্টিখানি ব্যাপার নয়। তবে এই দিক দিয়ে অনন্য হচ্ছে 'হেডলি' পরিবার; যাদের রয়েছে তিন প্রজন্ম ধরে টেস্ট খেলার ঐতিহ্য। জর্জ হেডলির ছেলে বাঁহাতি ব্যাটসম্যান রোনাল্ড হেডলি (২ টেস্ট, ২ ওয়ানডে) পরবর্তীতে খেলেছেন ওয়েস্ট ইন্ডিজের হয়ে। রোনাল্ডের ছেলে ফাস্ট বোলার ডিন হেডলিও আন্তর্জাতিক ক্রিকেটার। তবে ওয়েস্ট ইন্ডিজ নয়, তিনি প্রতিনিধিত্ব করেছেন ইংল্যান্ডের হয়ে; খেলেছেন ১৫টি টেস্ট এবং ১৩টি ওয়ানডে।

শেষ করব জর্জ হেডলি সম্পর্কে কয়েকটি অসাধারণ উদ্ধৃতি দিয়ে।

প্রয়াত ধারাভাষ্যকার টনি কোজিয়ারের ভাষায়, “He was a glorious strokemaker, perfectly balanced at the crease. He was an icon, an inspiration for his people. He overcame racism, the tyranny of distance to achieve greatness.”

সাবেক ফাস্ট বোলার মাইকেল হোল্ডিংয়ের ভাষায়, “George Headley is the greatest cricketer Jamaica has ever produced. And that stage of Jamaica's development, when young black people of Jamaica were looking to make a mark in Jamaica, Headley stood out like a beacon."

জ্যামাইকার সাবেক প্রধানমন্ত্রী মাইকেল ম্যানলির ভাষায়, "It was to the black masses that Headley had the deepest significance. He was the "Atlas" not just in sporting terms, but in his carrying the hopes of the black, English-speaking Caribbean man ... He was black excellence personified in a white world and in a white sport."