ক্রিকেট লেজেন্ডস

শন পোলক, যার ধমনীতে ক্রিকেট

ক্রিকফ্রেঞ্জি করেসপন্ডেন্ট

ক্রিকফ্রেঞ্জি করেসপন্ডেন্ট
প্রকাশের তারিখ: 17:41 শুক্রবার, 21 ডিসেম্বর, 2018

|| ফ্রাইডে স্পেশাল ||

১৯৯৬ সালের ৯ জানুয়ারি। সেদিন কেপটাউনের নিউল্যান্ডসে মুখোমুখি হয়েছিল স্বাগতিক দক্ষিণ আফ্রিকা ও ইংল্যান্ড। টসে জিতে প্রথমে ব্যাট করতে নামা দক্ষিণ আফ্রিকা মাত্র ১০৭ রান তুলতেই হারিয়ে ফেলল ৬ উইকেট! ইংলিশ পেস আক্রমণের সামনে রীতিমতো ধুঁকতে থাকা দলটাকে সেদিন খাদের কিনারা থেকে টেনে তুললেন ২২ বছরের এক আনকোরা তরুণ যার পরিচয় মূলত বোলিং অলরাউন্ডার। ৮ নম্বরে নেমে খেললেন ৬৬ বলে ৬৬ রানের হার না মানা এক ইনিংস। অভিষেকে ৮ নম্বরে নামা কোন ব্যাটসম্যানের সর্বোচ্চ রানও এখন পর্যন্ত এটাই। অসামান্য দৃঢ়তা দেখিয়ে দলকে এনে দিলেন ২১১ রানের লড়াকু পুঁজি।

কেবল ব্যাট হাতেই নয়, ফাস্ট বোলার হিসেবেও কম যান না সেই তরুণ। ব্যাটিংয়ের মত বোলিংয়েও নেতৃত্ব দিলেন সামনে থেকে।  'সাদা বিদ্যুৎ' খ্যাত পেস কিংবদন্তি অ্যালান ডোনাল্ডের সাথে জুটি বেঁধে রীতিমতো ছারখার করে দিলেন ইংলিশ ব্যাটিং লাইনআপ। ৯.৫ ওভার বল করে ৩৪ রানের বিনিময়ে তুলে নিলেন ৪ উইকেট। ১ বল বাকি থাকতেই ইংলিশরা অলআউট হল ২০৫ রানে। ফলে ৬ রানের স্বস্তির জয় পেল স্বাগতিক দক্ষিণ আফ্রিকা।

অভিষেকেই ব্যাটে বলে দ্যুতি ছড়ানো সেই তরুণ অলরাউন্ডারের হাতেই শেষমেশ উঠেছিল ম্যাচসেরার পুরস্কার। ওহ হো, তার পরিচয়টাই তো দেয়া হলো না এখনো! তিনি হলেন ক্রিকেটের সর্বকালের সেরা বোলিং অলরাউন্ডারদের একজন, কিংবদন্তি ফাস্ট বোলার শন পোলক।

শুরুতেই একটা তথ্য জানিয়ে রাখি। টেস্ট ক্রিকেটে ৯ জন আর ওয়ানডেতে মাত্র ৪ জন ক্রিকেটারের রয়েছে ৩০০০ রান এবং ৩০০ উইকেটের 'অলরাউন্ডারস ট্রিপল'। কিন্তু এদের মধ্যে মাত্র একজন আছেন যার টেস্ট এবং ওয়ানডে দুই ফরম্যাটেই রয়েছে ৩০০০ রান ও ৩০০ উইকেটের 'ট্রিপল' অর্জনের কৃতিত্ব। তিনি হলেন সাবেক প্রোটিয়া অলরাউন্ডার শন পোলক।

১৯৭৩ সালের ১৬ জুলাই, পোর্ট এলিজাবেথের একটি স্বনামধন্য ক্রিকেট পরিবারে জন্মেছিলেন শন পোলক। শনের বাবা পিটার এবং চাচা গ্রায়েম পোলক হলেন সাউথ আফ্রিকান ক্রিকেটের দুই 'স্টলওয়ার্ট'। ষাটের দশকে বিখ্যাত 'স্প্রিংবক' দলটির বোলিং আক্রমণের নেতৃত্বে ছিলেন শনের বাবা পিটার পোলক। আর চাচা গ্রায়েম পোলককে মনে করা হয়, সর্বকালের সেরা বাঁহাতি ব্যাটসম্যানদের একজন। উইজডেনের ভাষায়, “One of the finest, if not the finest, left-hander to play the game”.

এমনকি শনের দাদু অর্থাৎ গ্রায়েম ও পিটারের বাবা এন্ড্রু পোলক ছিলেন স্কটিশ বংশোদ্ভূত। তাঁর জন্মস্থান স্কটল্যান্ডের এডিনবার্গ। তিনিও একজন প্রভাবশালী ক্রিকেট ব্যক্তিত্ব ছিলেন। ঘরোয়া প্রথম শ্রেণীর ক্রিকেটে অংশ নিয়েছেন অরেঞ্জ ফ্রি স্টেট দলের হয়ে। দক্ষিণ আফ্রিকার ক্রিকেটে এই 'পোলক' পরিবারের মত এতটা সুদূরপ্রসারী প্রভাব আজ পর্যন্ত কেউ বিস্তার করতে পারে নি। তাই বলা যায়, যার রক্তে মিশে আছে ক্রিকেট, তিনি আর যাই হোক ক্রিকেটার না হয়ে যাবেন কোথায়!

আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে সীমিত দক্ষতা দিয়ে হাতে গোনা যে কজন বোলার নিজেদের শ্রেষ্ঠত্বের প্রমাণ দিয়েছেন তাদের মধ্যে পোলক অন্যতম। নিজের সময়ে তিনি ছিলেন বিশ্বের সবচাইতে কন্সিসটেন্ট বোলারদের একজন। পোলককে সমীহের চোখে দেখত না এমন ব্যাটসম্যান বোধ হয় খুঁজে পাওয়াই মুশকিল। পোলকের বোলিংয়ে একটা সহজ সরল ব্যাপার ছিল। লাইন-লেংথ ঠিক রেখে ধারাবাহিকভাবে বল করে যাওয়া। যেখানে গ্লেন ম্যাকগ্রার সঙ্গে পোলকের ছিল দারুণ মিল। 

ক্যারিয়ারের শুরুতে তিনি অবশ্য জেনুইন ফাস্ট বোলারই ছিলেন। তবে সময়ের সাথে পেস কমিয়ে মনোযোগী হন লাইন-লেন্থ এবং অ্যাকুরেসির দিকে।তাঁর সাফল্যের রেসিপিটা ছিল সিম্পল — বুদ্ধিমত্তা, নিয়ন্ত্রণ এবং সাটল মুভমেন্ট অফ দ্য সিম। আরেকটা কার্যকরী অস্ত্র ছিল ওয়েল ডিরেক্টেড বাউন্সার।

ক্রিকেটীয় দক্ষতার চাইতেও শন পোলক এগিয়ে ছিলেন মানসিক দিক থেকে। তাঁর ছিল অদম্য সাহস, কঠোর পরিশ্রম করার মানসিকতা ও প্রবল মনের জোর। আর ছিল চমৎকার ফিটনেস এবং দুর্দান্ত স্ট্যামিনা। লম্বা স্পেলে একটানা বোলিং করে যেতে পারতেন ঘন্টার পর ঘন্টা, সহজে ক্লান্ত হতেন না।

পোলকের বোলিংয়ে বৈচিত্র্য কম ছিল; তবে একেবারেই যে ছিল না তা কিন্তু নয়। ওয়ানডে ফরম্যাটে নিজের কার্যকারিতা প্রমাণ করতে উইকেটের চরিত্র বুঝে স্লোয়ার, অফ কাটার, ডেথ ওভারে ইয়র্কার, স্লোয়ার বাউন্সারের মত ভ্যারিয়েশনও বেশ ভালমতই রপ্ত করেছিলেন তিনি। পোলকের একটা বৈশিষ্ট্য ছিল যে তিনি ব্যাটসম্যানের দুর্বলতা পড়ে ফেলতে পারতেন সহজেই।

ক্রিকেটের সব সংস্করণ মিলিয়েই দক্ষিণ আফ্রিকার ইতিহাসে সফলতম বোলার এবং সর্বাধিক উইকেটের (৮২৯ উইকেট) মালিক হলেন শন পোলক। প্রথম সাউথ আফ্রিকান এবং বিশ্বের দশম বোলার হিসেবে টেস্ট ক্রিকেটে ৪০০ উইকেটের মাইলফলক স্পর্শ করেন তিনি।

আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে সবচেয়ে বেশি ১৩ বার নিয়েছেন শচীন টেন্ডুলকারের উইকেট! এছাড়া অ্যাডাম গিলক্রিস্ট, সনাৎ জয়াসুরিয়া এবং সৌরভ গাঙ্গুলিকে আউট করেছেন ১২ বার করে।

সীমিত ওভারের ক্রিকেটে 'কিপ্টে' বোলিংয়ের জন্য পোলকের একটা আলাদা সুখ্যাতি ছিল। ওয়ানডেতে কমপক্ষে ৯০০০ বল করেছেন এমন বোলারদের মধ্যে সর্বনিম্ন ইকোনমি রেটের (৩.৪৮) মালিক কার্টলি অ্যাম্ব্রোস; তার ঠিক পরেই আছেন শন পোলক (৩.৬৭)।

অবশ্য ওয়ানডেতে কমপক্ষে ৩০০ উইকেট নেয়া বোলারদের মধ্যে সেরা ইকোনমি রেটটা (৩.৬৭) কিন্তু পোলকেরই। দ্বিতীয় সেরা গ্লেন ম্যাকগ্রা (৩.৮৮)।

অনেকেই হয়ত জানেন না, দেশের মাটিতে সর্বোচ্চ ওডিয়াই উইকেটের মালিক হচ্ছেন শন পোলক। দক্ষিণ আফ্রিকার মাটিতে খেলা ১২৭ ওয়ানডেতে পোলকের শিকার মাত্র ২০.২৩ গড়ে ১৯৩ উইকেট। 

এবারে আসি পোলকের ক্যারিয়ার সেরা বোলিং পারফরম্যান্স প্রসঙ্গে। টেস্টে মাত্র একবারই ম্যাচে ১০ উইকেট লাভের কৃতিত্ব দেখিয়েছেন তিনি। ২০০১ সালে ব্লুমফন্টেইন টেস্টে ভারতের বিপক্ষে ১৪৭ রানে ১০ উইকেট (৪/৯১ ও ৬/৫৬) নিয়ে হয়েছিলেন ম্যাচসেরা।

টেস্টে বল হাতে পোলকের আরও কয়েকটি উল্লেখযোগ্য পারফরম্যান্সের মধ্যে রয়েছে —

• ২০০১ সালে উইন্ডিজের বিপক্ষে ৫/২৮ ও ৪/৬৬
• ১৯৯৮ সালে উইন্ডিজের বিপক্ষে ৫/৫৪ ও ৪/৪৯
• ১৯৯৮ সালে অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে ৭/৮৭ ও ২/৬১
• ১৯৯৯ সালে ইংল্যান্ডের বিপক্ষে ৪/১৬ ও ৪/৬৪
• ১৯৯৮ সালে ইংল্যান্ডের বিপক্ষে ৩/৫১ ও ৫/৫৩
• ২০০৩ সালে ইংল্যান্ডের বিপক্ষে ২/৬৫ ও ৬/৩৯
• ১৯৯৮ সালে পাকিস্তানের বিপক্ষে ২/৫৫ ও ৬/৫০

আর ওয়ানডেতে পোলকের সেরা বোলিং ৩৫ রানে ৬ উইকেট, ১৯৯৯ সালে ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে। অবশ্য দুর্দান্ত বোলিং করেও সেদিন দলকে জেতাতে ব্যর্থ হয়েছিলেন তিনি।

২০০০ সালে একটি ত্রিদেশীয় সিরিজের ফাইনালে ইংল্যান্ডের বিপক্ষে মাত্র ১৪৮ রানের পুঁজি ডিফেন্ড করে জিতেছিল সাউথ আফ্রিকা। টানা ৯ ওভারের বিধ্বংসী এক স্পেলে মাত্র ২০ রান খরচায় ৫ উইকেট তুলে নিয়েছিলেন শন পোলক। ৫ জনই ছিল প্রথম সারির ব্যাটসম্যান।

এরকম আরেকটি প্রলয়ঙ্করী স্পেলের কথা মনে পড়ে। ১৯৯৭ সালে লাহোরে পাকিস্তানের বিপক্ষে ইনিংসের প্রথম ওভারেই নিয়েছিলেন ৩ উইকেট! মাত্র ৫ বলের মধ্যে ফিরিয়ে দিয়েছিলেন সাঈদ আনোয়ার (০), আমির সোহেল (০) এবং ইজাজ আহমেদকে (০)। এরপর দলীয় ৯ রানের মাথায় আফ্রিদিকেও (৭) আউট করে রীতিমতো ধসিয়ে দিয়েছিলেন পাকিস্তানি টপ অর্ডার। শেষ পর্যন্ত ৩৯ রানে ৪ উইকেট নিয়ে হয়েছিলেন ম্যাচসেরা।

ওয়ানডেতে বল হাতে পোলকের আরও কয়েকটি উল্লেখযোগ্য স্পেলের মধ্যে রয়েছে —

• ১৯৯৯ বিশ্বকাপের সেমিফাইনালে অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে ৫/৩৬
• ২০০৭ সালে পাকিস্তানের বিপক্ষে ৫/২৩
• ২০০১ সালে ভারতের বিপক্ষে ৫/৩৭
• ২০০২ সালে শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে ৪/১৮
• ২০০৬ সালে ভারতের বিপক্ষে ৪/২৪
• ২০০৪ সালে উইন্ডিজের বিপক্ষে ৪/২৬
• ১৯৯৬ সালে ইংল্যান্ডের বিপক্ষে ৪/৩৪

১৯৯৬ সালের ঘটনা। ইংলিশ কাউন্টিতে অভিষেক ম্যাচ খেলতে নেমেছেন শন পোলক। ওয়ারউইকশায়ারের হয়ে লেস্টারশায়ারের বিপক্ষে সে ম্যাচে তিনি গড়ে ফেললেন অবিশ্বাস্য এক কীর্তি! লিস্ট 'এ' ক্রিকেটের ইতিহাসে মাত্র দ্বিতীয় বোলার হিসেবে নাম লেখালেন 'ফোর ইন ফোর' অর্থাৎ টানা ৪ বলে ৪ উইকেট প্রাপ্তির খাতায়!

ক্রিকেটে বিশেষ করে পেসারদের রয়েছে জোড়া বেঁধে উইকেট শিকারের চল। নব্বইয়ের দশকের শেষভাগে পোলক যেমন জুটি বেঁধেছিলেন অ্যালান ডোলাল্ডের সাথে। ডোনাল্ড-পোলক জুটির রসায়নটাও জমত বেশ। তাঁরা ছিলেন একে অপরের পরিপূরক। ডোনাল্ড এক প্রান্ত থেকে গতির ঝড় তুলতেন। অন্যদিকে নিখুঁত লাইন-লেন্থের আঁটোসাঁটো বোলিং দিয়ে ব্যাটসম্যানদের ক্রমাগত চাপে রাখার কাজটা করতেন পোলক। ডোনাল্ডের জায়গাটা পরে নিয়েছিলেন মাখায়া এনটিনি। 

'বোলার' পোলক নিয়ে তো অনেক কথাই হল; এবারে আসি 'ব্যাটসম্যান' পোলক প্রসঙ্গে। পোলক ব্যাটসম্যান হিসেবেও ছিলেন যথেষ্ট সামর্থ্যবান। ব্যাট করতেন মূলত লোয়ার অর্ডারে; ৮-৯ নম্বরে। ফলে ব্যাটিংয়ের সুযোগ পেতেন কম। তবে দলের প্রয়োজনে ইনিংসের হাল ধরতে জানতেন তিনি। সীমিত ওভারের ক্রিকেটে তাঁর পরিচয় ছিল একজন দক্ষ পিঞ্চ হিটার। কাট, পুল এবং লফটেড শটে পারদর্শী ছিলেন; অল্প সময়ে দ্রুত রান তোলায় তাঁর ছিল জুড়ি মেলা ভার।

২০০৭ সালে ভারতে অনুষ্ঠিত আফ্রো-এশিয়া কাপে ইনজুরির কারণে পোলক খেলেছিলেন 'স্পেশালিষ্ট ব্যাটসম্যান' হিসেবে। বেঙ্গালুরুর চিন্নাস্বামী স্টেডিয়ামে এশিয়া একাদশের বিপক্ষে প্রথম ওয়ানডেতে নেমেছিলেন ৭ নম্বরে। ১৯ বাউন্ডারি আর ২ ছক্কায় উপহার দিয়েছিলেন ১১০ বলে ১৩০ রানের অনবদ্য এক ইনিংস। আন্তর্জাতিক সীমিত ওভারের ক্রিকেটে এটাই তাঁর একমাত্র সেঞ্চুরি। মজার ব্যাপার হল, সেঞ্চুরিটা এসেছিল ১৮৯ ইনিংস পর! যা একটি বিশ্বরেকর্ড। 

ওয়ানডেতে ব্যাট হাতে পোলকের ম্যাচ জেতানো উল্লেখযোগ্য কিছু ইনিংসের মধ্যে রয়েছে —

• ২০০৭ সালে পাকিস্তানের বিপক্ষে ৮৪ বলে ৯০
• ১৯৯৭ সালে জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে ৭৩ বলে ৭৫
• ২০০২ সালে নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে ৩৪ বলে ৬৯*
• ১৯৯৬ সালে ইংল্যান্ডের বিপক্ষে ৬৬ বলে ৬৬
• ১৯৯৮ সালে পাকিস্তানের বিপক্ষে ৭২ বলে ৬৬

কেবল সীমিত ওভারের কথাই বা বলছি কেন, টেস্ট ক্রিকেটেও লোয়ার মিডল অর্ডারে বেশ নির্ভরযোগ্য ব্যাটসম্যান ছিলেন পোলক। টেস্টে ১৬টি ফিফটি ও ২টি সেঞ্চুরি আছে তাঁর। দুটো সেঞ্চুরিই করেছিলেন নয় নম্বরে নেমে। এটাও একটা রেকর্ড। টেস্টে ৯ নম্বরে নেমে দুটো সেঞ্চুরি যে আর কারোই নেই!

টেস্টে পোলকের ক্যারিয়ার সেরা ইনিংসটি এসেছিল শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে, ২০০১ সালে সেঞ্চুরিয়ন টেস্টে। নয় নম্বরে নেমে খেলেছিলেন ১৬ বাউন্ডারি ও ৩ ছক্কায় সাজানো ১০৬ বলে ১১১ রানের বিধ্বংসী এক ইনিংস; হয়েছিলেন ম্যাচসেরা।

অনেকের মতে টেস্টে ব্যাটসম্যান হিসেবে শন পোলক ছিলেন 'আন্ডারপারফর্মড'। তাঁর ব্যাটিং সামর্থ্যটা পুরোপুরি কাজে লাগাতে পারে নি দক্ষিণ আফ্রিকা।

ব্যাটিং-বোলিংয়ের পাশাপাশি ফিল্ডার হিসেবেও দুর্দান্ত ছিলেন পোলক। টেস্টে, ওয়ানডে, টি২০ মিলিয়ে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে ১৮২টি ক্যাচের মালিক তিনি।

এবার আসি পোলকের ক্যাপ্টেন্সি প্রসঙ্গে। ২০০০ সালের এপ্রিলে অধিনায়কের দায়িত্ব যখন পেলেন, দক্ষিণ আফ্রিকান ক্রিকেটে তখন ঘোর অমানিশা। নিয়মিত অধিনায়ক হানসি ক্রনিয়ের ফিক্সিং কেলেঙ্কারিতে জড়িত থাকার ঘটনা প্রমাণিত হলে আজীবন নিষিদ্ধ করা হয় তাঁকে। এরকম একটা ঘটনায় দক্ষিণ আফ্রিকান ক্রিকেটের ভিতটাই কেঁপে উঠেছিল। শেষমেশ ক্যাপ্টেন্সির গুরুভার চাপিয়ে দেয়া হয় সহ-অধিনায়ক পোলকের কাঁধে। নেতৃত্বটা তাই পোলকের জন্য ছিল বিশাল বড় একটা চ্যালেঞ্জ।

অধিনায়ক হিসেবে পোলক মোটামুটি সফলই ছিলেন বলা যায়। তাঁর নেতৃত্বে খেলা ২৬ টেস্টের ১৪টিতেই জিতেছে দক্ষিণ আফ্রিকা, হেরেছে মাত্র ৫টি। সাফল্যের শতকরা হার ৫৩.৮৪% যা তাঁর পূর্বসূরি হ্যান্সি ক্রনিয়ে এবং উত্তরসূরি গ্রায়েম স্মিথের চাইতেও বেশি। এছাড়া পোলকের নেতৃত্বে ৯৮টি ওয়ানডে ম্যাচের ৬০টিতেই জিতেছে প্রোটিয়ারা, হেরেছে ৩৪টি। সাফল্যের শতকরা হার ৬৩.৮৩% যা দক্ষিণ আফ্রিকাকে অন্তত ২০টির বেশি ওয়ানডেতে নেতৃত্ব দেয়া যেকোন অধিনায়কের চেয়ে বেশি।

এদিকে ২০০৩ বিশ্বকাপের গ্রুপ পর্ব থেকেই বাদ পড়ে পোলকের নেতৃত্বাধীন দক্ষিণ আফ্রিকা। বিশ্বকাপের স্বাগতিক দলের এহেন ভরাডুবির দায়ে টুর্নামেন্টের পরপরই পোলককে অধিনায়কের পদ থেকে অব্যাহতি দেয়া হয়।

চলুন এক নজরে দেখে নিই শন পোলকের আন্তর্জাতিক ক্যারিয়ার পরিসংখ্যান:

টেস্ট: 

১০৮ ম্যাচে ৩২.৩১ গড়ে করেছেন ৩৭৮১ রান। ১৬টি ফিফটি ও ২টি সেঞ্চুরি। সর্বোচ্চ ১১১, বিপক্ষ শ্রীলঙ্কা।

বল হাতে মাত্র ২৩.১১ গড়ে উইকেট নিয়েছেন ৪২১টি। ইনিংসে ৫ উইকেট ১৬ বার এবং ম্যাচে ১০ উইকেট লাভ করেছেন ১ বার। সেরা বোলিং ৭/৮৭, বিপক্ষ অস্ট্রেলিয়া।

ওয়ানডে:

৩০৩ ম্যাচে ২৬.৪৫ গড়ে ৩৫১৯ রান। স্ট্রাইক রেট ৮৬.৭০। ফিফটি ১৪টা ও সেঞ্চুরি ১টা। সর্বোচ্চ ১৩০, বিপক্ষ এশিয়া একাদশ।

বল হাতে ২৪.৫০ গড়ে নিয়েছেন ৩৯৩ উইকেট। ইকোনমি রেট ৩.৬৭। ম্যাচে ৪ উইকেট ১২ বার এবং ৫ উইকেট নিয়েছেন ৫ বার। সেরা বোলিং ৬/৩৫, বিপক্ষ উইন্ডিজ।

টি২০:

১২টি আন্তর্জাতিক টি২০ ম্যাচ খেলে ১২.২৮ গড়ে রান করেছেন ৮৬। স্ট্রাইক রেট ১২২.৮৫। সর্বোচ্চ ৩৬*, বিপক্ষ উইন্ডিজ।

বল হাতে ২০.৬০ গড়ে নিয়েছেন ১৫ উইকেট। ইকোনমি ৭.৬২ আর সেরা বোলিং ৩/২৮, বিপক্ষ নিউজিল্যান্ড।

আইসিসি র‍্যাংকিংয়ে সর্বোচ্চ রেটিং পয়েন্ট নিয়ে টেস্ট এবং ওয়ানডে দুই ফরম্যাটেই বোলারদের শীর্ষস্থান দখল করেছেন একবার করে। একটা সময় ক্যালিস-ফ্লিনটফদের পেছনে ফেলে আইসিসি র‍্যাংকিংয়ে অলরাউন্ডারদের শীর্ষস্থানটাও নিজের করে নিয়েছিলেন শন পোলক। এছাড়া উইজডেন বর্ষসেরার মুকুটও একবার মাথায় তুলেছেন, ২০০৩ সালে।

টেস্টে ১১ বার এবং ওয়ানডেতে সর্বমোট ১৬ বার ম্যাচসেরার পুরস্কার জিতেছেন শন পোলক। তবে দক্ষিণ আফ্রিকার হয়ে তিনটি বিশ্বকাপ খেলা এই কিংবদন্তী অলরাউন্ডারের ক্যারিয়ারে সবচেয়ে বড় আক্ষেপ বোধ হয় কখনো বিশ্বকাপ জিততে না পারা।

শেষ করব একটি ইন্টারেস্টিং তথ্য দিয়ে। টেস্ট ক্রিকেটে পিতা-পুত্র হিসেবে সবচেয়ে বেশি উইকেটের মালিক শন পোলক আর পিটার পোলক জুটি। ১০৮ ম্যাচে শনের ৪২১ আর ২৮ ম্যাচে পিটারের ১১৬ উইকেটের যোগফল দাঁড়ায় ৫৩৭ উইকেট যা টেস্ট ইতিহাসে পিতা-পুত্রের জুটি হিসেবে সর্বোচ্চ।