ক্রিকেট লিজেন্ডস

গৌতম গম্ভীরঃ ভারতীয় ক্রিকেটের আনসাং হিরো

ক্রিকফ্রেঞ্জি করেসপন্ডেন্ট

ক্রিকফ্রেঞ্জি করেসপন্ডেন্ট
প্রকাশের তারিখ: 21:50 শুক্রবার, 07 ডিসেম্বর, 2018

|| ফ্রাইডে স্পেশাল ||

সম্প্রতি সব ধরনের ক্রিকেট থেকে অবসরের ঘোষণা দিয়েছেন ভারতের দু’টি বিশ্বকাপ জয়ের নায়ক গৌতম গম্ভীর। গত বৃহস্পতিবার থেকে শুরু হওয়া দিল্লী বনাম অন্ধ্র প্রদেশের মধ্যকার রঞ্জি ট্রফির ম্যাচটিই হতে চলেছে তাঁর পেশাদার ক্যারিয়ারের শেষ প্রতিযোগিতামূলক ম্যাচ। সদ্য সাবেক হওয়া ৩৭ বছর বয়সী এই বাঁহাতি ওপেনার ভারতের হয়ে খেলেছেন দীর্ঘ ১৩ বছর, সব ফরম্যাট মিলিয়ে রান করেছেন ১০ হাজারেরও বেশী।

এখন প্রশ্ন হল, একজন 'ক্রিকেটার' গৌতম গম্ভীরকে মানুষ কেন মনে রাখবে? প্রথমত, গম্ভীরের সহজাত ব্যাটিং সৌন্দর্য। টিপিক্যাল লেফট হ্যান্ডার্স এলিগেন্স পাওয়া যেত তাঁর ব্যাটিংয়ে। স্পিনারদের বিপক্ষে তাঁর সাবলীল ও চনমনে ফুটওয়ার্ক, ডাউন দ্য উইকেটে গিয়ে মিড উইকেট এবং এক্সট্রা কাভারের ওপর দিয়ে খেলা 'চিপ শট', কব্জির মোচড়ে শৈল্পিক ফ্লিক, নান্দনিক স্কয়ার কাট, কাভার ড্রাইভ, ওয়াইড মিড অনের ওপর দিয়ে অনায়াস ভঙ্গিতে মারা লফটেড শট — ক্রিকেটের সৌন্দর্যপিপাসু যারা আছেন, তারা কোনদিনই ভুলবেন না।

দ্বিতীয়ত, ২০০৭ সালের প্রথম ওয়ার্ল্ড টি২০ ও ২০১১ সালের বিশ্বকাপ ফাইনালে ভারতকে শিরোপা এনে দেয়া ৭৫ ও ৯৭ রানের 'মহামূল্যবান' দুটি ইনিংস। মজার ব্যাপার হল, দুটো ফাইনালেই গম্ভীর ছিলেন 'আনসাং হিরো'। ব্যাট হাতে দলের টপ স্কোরার হওয়া সত্ত্বেও মূল কৃতিত্বটা ছিনিয়ে নিয়ে গেছে অন্য কেউ।

স্পিনের বিপক্ষে গম্ভীরকে মনে করা হয় সর্বকালের সেরাদের একজন। তাঁর স্পিন খেলার সামর্থ্য, টেকনিক, কবজি এবং পায়ের কাজ ছিল এককথায় অতুলনীয়। বলা হয়ে থাকে যে প্রকৃতিগতভাবেই বাঁহাতিরা অফ স্পিনে দুর্বল। কিন্তু গম্ভীর মোটেও তেমনটা ছিলেন না। তাঁর সোজা ব্যাটে খেলা নিখুঁত ফরোয়ার্ড ডিফেন্স কিংবা পায়ের চমকপ্রদ ব্যবহারে সাহসী স্ট্রোকপ্লে দেখে মুগ্ধ হন নি এমন কাউকে হয়ত খুঁজলেও পাওয়া যাবে না।

গম্ভীরের অফ স্পিন খেলার টেকনিক সম্পর্কে উইজডেন বলছে, “Since only his toes are in line with the ball, his front pad isn't in the way of his bat coming down straight in case the ball turns into him. At the same time, his front leg is close enough to the initial line to enable him, with a full bend of his knee, to get his head over the offbreak and either defend it or, if the degree of turn is extravagant, pad it away.”

স্পিনের বিপক্ষে গম্ভীরের টেকনিক্যাল এক্সিলেন্সির প্রমাণ পাওয়া যায় ২০০৮-০৯ সালের শ্রীলঙ্কা সফরে। দলে টেন্ডুলকার, দ্রাবিড়, সৌরভ, লক্ষণের মত ব্যাটসম্যান থাকা সত্ত্বেও ভারতকে সেবার সিরিজ হারতে হয়েছিল ২-১ ব্যবধানে। মুরালি-মেন্ডিস জুটির দুর্বোধ্য স্পিন ভেলকির সামনে ভারতের প্রতিষ্ঠিত ব্যাটিং লিজেন্ডদের নাকানিচুবানি খাওয়ার ভিড়ে গম্ভীর ছিলেন আশ্চর্য ব্যতিক্রম।

একটা পরিসংখ্যান দিই তাহলে বুঝতে সুবিধা হবে। সিরিজে শচীন, সৌরভ, দ্রাবিড় এবং লক্ষণের ব্যাটিং গড় ছিল যথাক্রমে ১৫, ১৬, ২৪ এবং ৪৩! অথচ গম্ভীরের বেলায় তা ৫১.৬৭!

একটু পেছন ফিরে তাকানো যাক। ১৯৮১ সালের ১৪ অক্টোবর, দিল্লির একটি সম্ভ্রান্ত হিন্দু পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন গৌতম গম্ভীর। বাবা দীপক গম্ভীর একজন টেক্সটাইল ব্যবসায়ী ও মা সীমা গম্ভীর গৃহিণী। তাঁর ক্রিকেটে হাতেখড়ি মাত্র দশ বছর বয়সে, দিল্লির লাল বাহাদুর শাস্ত্রী ক্রিকেট একাডেমিতে কোচ সঞ্জয় ভরদ্বাজের হাত ধরে।

১৯৯৯-২০০০ সালে রঞ্জি ট্রফিতে দিল্লির হয়ে ফার্স্ট ক্লাস অভিষেক। ২০০২ মৌসুমে টানা দুই ম্যাচে 'ডাবল সেঞ্চুরি' হাঁকিয়ে আলোচনায় উঠে আসেন ২১ বছর বয়সী এই ওপেনার। ২০০৩ সালে বাংলাদেশের বিপক্ষে ওয়ানডে অভিষেক, ঢাকায় আয়োজিত তিনজাতি টুর্নামেন্ট টিভিএস কাপে। ক্যারিয়ারে তৃতীয় ওয়ানডেতেই পেয়ে যান ফিফটির দেখা, বাংলাদেশের বিপক্ষে ৮৯ বলে ৭১ রান করে হয়েছিলেন ম্যাচসেরা।

পরের বছর টেস্ট অভিষেক, দেশের মাটিতে অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে। ব্যাট হাতে ব্যর্থ ছিলেন দুই ইনিংসেই; করেছিলেন মাত্র ১ এবং ৩ রান। 

২০০৪ সালের ১৬ই ডিসেম্বর, বাংলাদেশের বিপক্ষে হাঁকান ক্যারিয়ারের প্রথম টেস্ট সেঞ্চুরি; চট্টগ্রামের এম.এ আজিজ স্টেডিয়ামে।

২০০৫ সালের নভেম্বরে শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে পেয়ে যান একদিনের আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে প্রথম শতরানের দেখা। তবে ৯৭ বলে ১০৩ রানের অনবদ্য ইনিংস খেলেও দলকে জেতাতে ব্যর্থ হন তিনি।

উল্লেখ্য, ২০০৪ সালে অভিষিক্ত গম্ভীরের প্রথম ১৩ টেস্টের ব্যাটিং গড় ছিল মাত্র ৩৬। অর্জন বলতে ছিল কেবল বাংলাদেশের বিপক্ষে 'সেঞ্চুরি' (১৩৯) আর জিম্বাবুয়ে ও দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে দুটো 'নড়বড়ে নব্বই' (৯৭ ও ৯৬)! রেকর্ড হিসেবে খুব খারাপ বলা যাবে না কিন্তু তারকাসমৃদ্ধ ভারতীয় ব্যাটিং লাইনআপের সাথে প্রতিযোগিতায় টিকে থাকার জন্য তা যথেষ্ট ছিল না মোটেও। ফলাফল টানা দুই বছরের জন্য টেস্ট দলের বাইরে। গম্ভীরের স্থলাভিষিক্ত হন ঘরোয়া ক্রিকেটে রানবন্যা বইয়ে দেয়া মুম্বাইয়ের ওয়াসিম জাফর।

গম্ভীরের বিরুদ্ধে সবসময়ের অভিযোগ ছিল, ভাল শুরুর পরেও ইনিংস লম্বা করতে পারতেন না তিনি। ন্যাচারালি গিফটেড স্ট্রোক প্লেয়ার হলেও তাঁর টেম্পারমেন্ট, এপ্রোচ এবং শট সিলেকশন ছিল প্রশ্নবিদ্ধ। বিশেষ করে কোয়ালিটি পেস আক্রমণের সামনে মোটেই স্বচ্ছন্দ ছিলেন না তিনি। বাঁহাতি পেসার চামিন্দা ভাসের 'বানি'তে পরিণত হয়েছিলেন; দুর্বলতা আবিষ্কৃত হয়েছিল শর্ট বলের বিরুদ্ধেও।

এদিকে অভিষেকের পর থেকে ওয়ানডেতে টানা সুযোগ পেয়েও খুব একটা সুবিধা করতে পারছিলেন না। ক্যারিয়ারের প্রথম ১৯ ম্যাচ শেষে তাঁর ব্যাটিং গড় ছিল মাত্র ২৫.২৬। ২০০৭ বিশ্বকাপের দল থেকে বাদ পড়াটা তাই একরকম অবধারিতই ছিল। তাঁর বদলে নেয়া হয়েছিল তরুণ ডানহাতি ওপেনার রবিন উথাপ্পাকে। বিশ্বকাপের দলে সুযোগ না পেয়ে গম্ভীর নাকি এতটাই আঘাত পেয়েছিলেন যে খেলাই ছেড়ে দিতে চেয়েছিলেন।

উল্লেখ্য, সেবার বাংলাদেশ ও শ্রীলঙ্কার কাছে হেরে বিশ্বকাপের প্রথম রাউন্ড থেকেই বাদ পড়েছিল ভারত।

বিশ্বকাপের পর বাংলাদেশ এবং আয়ারল্যান্ড সফরের ওয়ানডে দলে আবারও ডাক পান তিনি। কামব্যাকের পর দ্বিতীয় ম্যাচেই হাঁকান দুর্দান্ত এক সেঞ্চুরি; মিরপুরে বাংলাদেশের বিপক্ষে ১২১ বলে ১১৩ রান করে জিতে নেন ম্যাচসেরার পুরস্কার। এরপর আয়ারল্যান্ড সফরের প্রথম ওয়ানডেতেই ৮০ রানের দুর্দান্ত এক ইনিংস খেলে ম্যাচসেরা হন আরও একবার।

২০০৭ সালের সেপ্টেম্বরে দক্ষিণ আফ্রিকায় বসেছিল আইসিসি ওয়ার্ল্ড টি-টুয়েন্টির প্রথম আসর। ফাইনালে মুখোমুখি হয়েছিল চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী দুই দেশ ভারত ও পাকিস্তান। টসে জিতে প্রথমে ব্যাট করা ভারতের সংগ্রহ ছিল ৫ উইকেটে ১৫৭ রান। ৫৪ বলে ৮ চার ও ৩ ছক্কায় ওপেনার গৌতম গম্ভীরের ব্যাট থেকে এসেছিল সর্বোচ্চ ৭৫ রান। শেষ পর্যন্ত মাত্র ৫ রানে জেতা ফাইনালের অন্যতম শিরোপা নির্ধারক হয়ে দাঁড়িয়েছিল এই ইনিংসটাই।

গম্ভীর ব্যাট হাতে সর্বোচ্চ রান করলেও ম্যাচসেরার পুরস্কারটা উঠেছিল মাত্র ১৬ রান দিয়ে ৩ উইকেট শিকার করা বাঁহাতি পেসার ইরফান পাঠানের হাতে।

উল্লেখ্য, টুর্নামেন্টে ভারতের পক্ষে সর্বোচ্চ রানসংগ্রাহক গৌতম গম্ভীর। ছয় ম্যাচে তিন ফিফটিতে ১২৯.৭১ স্ট্রাইক রেটে তাঁর ব্যাট থেকে এসেছিল ২২৯ রান।

২০০৮ সালের ফেব্রুয়ারি-মার্চে অস্ট্রেলিয়ার মাটিতে আয়োজিত কমনওয়েলথ ব্যাংক ত্রিদেশীয় সিরিজের শিরোপা জিতেছিল ভারত। ৯ ম্যাচে দুই সেঞ্চুরিসহ ৫৫.০ গড়ে ৪৪০ রান নিয়ে টুর্নামেন্টের সর্বোচ্চ রানসংগ্রাহক ছিলেন গৌতম গম্ভীর।

গম্ভীরের স্পিন খেলার পারদর্শিতার কথা শুরুতেই একবার বলেছি। ঠিক এই কারণেই দুই বছর বিরতির পর তাঁকে পুনরায় ফেরানো হয় শ্রীলঙ্কা সফরের টেস্ট দলে। ২০০৮-০৯ সালের শ্রীলঙ্কা সফরটা ছিল তাই গম্ভীরের প্রত্যাবর্তন সিরিজ। ৬ ইনিংসে ৫১.৬৭ গড়ে ৩১০ রান করে তাঁর ওপর নির্বাচকদের আস্থার যথাযোগ্য প্রতিদানও দিয়েছিলেন তিনি।

২০০৮-০৯ সালের গম্ভীর ছিলেন আরও অনেক দিক থেকেই আলাদা। তিনি কেবল স্পিনটাই ভাল খেলতেন না, দক্ষতা অর্জন করেছিলেন ফাস্ট বোলিং সামলানোতেও। দেশে এবং দেশের বাইরে দুই জায়গাতেই পেয়েছিলেন সফলতা।

২০০৮-০৯ সালে টানা চার সিরিজে তিন শতাধিক রান সংগ্রহের বিরল কৃতিত্ব স্থাপন করেন গম্ভীর। শ্রীলঙ্কার বিরুদ্ধে ৫১.৬৭ গড়ে ৩১০, অস্ট্রেলিয়ার বিরুদ্ধে ৭৭.১৭ গড়ে ৪৬৩, ইংল্যান্ডের বিরুদ্ধে ৯০.২৫ গড়ে ৩৬১ এবং নিউজিল্যান্ডের বিরুদ্ধে করেন ৮৯.০ গড়ে ৪৪৫ রান। উল্লেখ্য, আর কোন ভারতীয় ব্যাটসম্যানের এই রেকর্ড নেই।

২০০৮ সালে 'দেশের মাটিতে' অস্ট্রেলিয়া এবং ইংল্যান্ডের বিপক্ষে সেঞ্চুরির পর ২০০৯ সালে নিউজিল্যান্ডের মাটিতে হাঁকান 'ব্যাক টু ব্যাক' সেঞ্চুরি। নেপিয়ার টেস্টের দ্বিতীয় ইনিংসে ফলোঅন করতে নেমে খেলা গম্ভীরের ৪৩৬ বলে ১৩৭ রানের মাস্টারক্লাসটি টেস্ট ইতিহাসেরই অন্যতম সেরা 'ম্যাচ সেভিং' নক। স্বভাববিরুদ্ধ রক্ষণাত্মক ভঙ্গিতে খেলা গম্ভীরের অবিশ্বাস্য ইনিংসটির স্থায়ীত্বকাল ছিল সাড়ে ছয় ঘন্টারও বেশি (৬৪৩ মিনিট)! এরকম কালজয়ী একটি ইনিংসের মাহাত্ম্য আসলে পরিসংখ্যান দিয়ে বোঝানো সম্ভব নয়। ওই ইনিংসের পর গম্ভীরকে রাহুল দ্রাবিড়ের সাথে তুলনা করেছিলেন সতীর্থ বীরেন্দর শেবাগ। অভিহিত করেছিলেন  'দ্য সেকেন্ড ওয়াল' নামে।

উল্লেখ্য, গম্ভীরের ব্যাটিং বীরত্বেই ৪১ বছর পর নিউজিল্যান্ডের মাটিতে টেস্ট সিরিজ জয়ের (১-০) কীর্তি গড়েছিল ভারত।

একই বছর দেশের মাটিতে শ্রীলঙ্কা এবং পরের বছর বাংলাদেশ সফরেও টেস্টে সেঞ্চুরি হাঁকিয়েছিলেন গম্ভীর। ব্যাট হাতে অবিশ্বাস্য ধারাবাহিকতার পুরস্কারস্বরূপ ২০০৯ সালে তিনি প্রথমবারের মত উঠে আসেন আইসিসি টেস্ট র্যাংকিংয়ের শীর্ষস্থানে। শুধু তাই নয়, সে বছর আইসিসি নির্বাচিত বর্ষসেরা টেস্ট ক্রিকেটারের মর্যাদায়ও ভূষিত হয়েছিলেন।

২০০৮ সালের শ্রীলঙ্কা সিরিজ থেকে ২০১০-১১ সালের দক্ষিণ আফ্রিকা সফর পর্যন্ত সময়টা ছিল গম্ভীরের টেস্ট ক্যারিয়ারের সবচাইতে তাৎপর্যপূর্ণ অধ্যায়। এই তিন বছরে খেলা ২৪ টেস্টে গম্ভীরের সংগ্রহ ছিল ৮ সেঞ্চুরিতে ২৫৪২ রান, গড় ৬২!

শুধু কি তাই? এই সময়কালের ভেতরে টেস্ট ক্রিকেটে দুটি অসাধারণ ব্যক্তিগত রেকর্ডেরও জন্ম দিয়েছিলেন গম্ভীর। টানা ৫ টেস্টে 'সেঞ্চুরি' আর টানা ১১ টেস্টে হাঁকিয়েছিলেন 'হাফ সেঞ্চুরি'! যেখানে টানা ৬ টেস্টে সেঞ্চুরি আছে শুধুমাত্র স্যার ডন ব্র্যাডম্যানের! আর টানা ১২ টেস্টে হাফ সেঞ্চুরির কৃতিত্ব দেখিয়েছেন শুধুমাত্র এবি ডি ভিলিয়ার্স।

২০১০ সালে দেশের মাটিতে নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে ওয়ানডে সিরিজে অধিনায়ক নির্বাচিত করা হয় গৌতম গম্ভীরকে। গম্ভীরের নেতৃত্বে সেই সিরিজে নিউজিল্যান্ডকে ৫-০ ব্যবধানে হোয়াইটওয়াশ করে ভারত। ৫ ম্যাচে ২ সেঞ্চুরিসহ ১০৯.৬৭ গড়ে ৩২৯ রান করে সিরিজসেরা হয়েছিলেন গৌতম গম্ভীর।

২০১০-১১ সালের দক্ষিণ আফ্রিকা সফরটা ছিল ভারতের জন্য অত্যন্ত কঠিন একটা সিরিজ। ইনজুরির কারণে দ্বিতীয় টেস্টটা মিস করলেও বাকি দুই টেস্টের চার ইনিংসে তিনবার ফিফটির দেখা পেয়েছিলেন গম্ভীর। সিরিজ নির্ধারণী' কেপটাউন টেস্টে ৯৩ ও ৬৪ রানের দুটি 'আত্মবিশ্বাসী' ইনিংস খেলে দলকে বাঁচিয়েছিলেন নিশ্চিত পরাজয়ের হাত থেকে। অসমান বাউন্সের দুরূহ উইকেটে ভয়ঙ্কর ফর্মে থাকা স্টেইন-মরকেল জুটির বিরুদ্ধে নিজের সেরাটা দিয়েই লড়েছিলেন গম্ভীর।

তীব্র প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ তিন ম্যাচের সিরিজটা শেষ পর্যন্ত ড্র হয়েছিল ১-১ ব্যবধানে। ৬০.৫ গড়ে গম্ভীরের ব্যাট থেকে এসেছিল ২৪২ রান।

দক্ষিণ আফ্রিকা সফর শেষে ইতিহাসে প্রথমবারের মত বিশ্বের এক নম্বর টেস্ট দলের স্বীকৃতি লাভ করে ভারত। ২৯ বছর বয়সী ওপেনার গৌতম গম্ভীর তখন ফর্মের তুঙ্গে, টেস্ট গড় ৫১.৩৩! তবে এই ফর্মটা ক্যারিয়ারের শেষ অবধি আর ধরে রাখতে পারেন নি তিনি।

২০১১ সালে দেশের মাটিতে আয়োজিত বিশ্বকাপের ফাইনালে উঠেছিল দুই প্রতিবেশী দেশ ভারত এবং শ্রীলঙ্কা। মুম্বাইয়ের ওয়াংখেড়ে স্টেডিয়ামে ভারতের প্রতিপক্ষ কেবল শ্রীলঙ্কা ছিল না; ছিল ইতিহাসও। মাহেলা জয়াবর্ধনের অনবদ্য সেঞ্চুরিতে (১০৩) ভর করে লঙ্কানদের বেঁধে দেয়া ২৭৫ রানের লক্ষ্য তাড়া করতে নেমে শুরুতেই হোঁচট খায় ভারত। লাসিথ মালিঙ্গার জোড়া আঘাতে মাত্র ৩১ রান তুলতেই প্যাভিলিয়নে ফিরে যান দুই 'ইনফর্ম' ওপেনার বীরেন্দর শেবাগ ও শচীন টেন্ডুলকার। এই অবস্থায় একপ্রান্ত আগলে রেখে ইনিংসের হাল ধরেন ওয়ান ডাউনে নামা গৌতম গম্ভীর। চতুর্থ উইকেটে কোহলির সাথে ৮৩ এবং পঞ্চম উইকেটে অধিনায়ক ধোনির সাথে ১০৯ রানের দুটো ম্যাচ উইনিং পার্টনারশিপ গড়ে দলকে জয়ের বন্দরে পৌঁছে দেবার মূল কৃতিত্বটা ছিল গৌতমেরই। সেঞ্চুরি থেকে মাত্র ৩ রান দূরে থাকতে থিসারা পেরেরার বলে যখন তিনি বোল্ড হলেন, দল তখন সম্পূর্ণ বিপদমুক্ত। ৭৯ বলে অপরাজিত ৯১ রানের দুর্দান্ত ইনিংস খেলে ধোনি ম্যাচসেরা হলেও গম্ভীরের ১২১ বলে ৯৭ রানের দায়িত্বশীল ইনিংসটির গুরুত্ব তাতে কমে যায় না এতটুকুও।

উল্লেখ্য, শচীন টেন্ডুলকারের (৪৮২) পর ভারতের পক্ষে টুর্নামেন্টের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ রান সংগ্রাহক ছিলেন গৌতম গম্ভীর (৩৯৩)।

বিশ্বকাপের পর গম্ভীর রান পেয়েছিলেন ইংল্যান্ড এবং শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে ওয়ানডে সিরিজেও। ২০১২ সালে অস্ট্রেলিয়ায় অনুষ্ঠিত কমনওয়েলথ ব্যাংক ত্রিদেশীয় সিরিজেও কোহলির পর (৩৭৩ রান) দলের পক্ষে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ ৩০৮ রান এসেছিল গম্ভীরের ব্যাট থেকেই। তবে ২০১২-১৩ সালে ওয়েস্ট ইন্ডিজ, পাকিস্তান এবং ইংল্যান্ড সিরিজের টানা ব্যর্থতায় অবশেষে ওয়ানডে দল থেকে বাদ পড়েন তিনি। এরপর আর কখনোই ফিরতে পারেন নি তিনি। 

এদিকে টানা ব্যর্থতার দায়ে বাদ পড়েন টেস্ট দল থেকেও। ২০১০ সালের ফেব্রুয়ারি থেকে ২০১২ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত ২৫ টেস্টে গম্ভীরের সংগ্রহ ছিল মাত্র ২৮.৬৬ গড়ে ১২৬১ রান।

এরপর ২০১৪ সালে একবার ইংল্যান্ড এবং ২০১৬ সালে নিউজিল্যান্ড ও ইংল্যান্ডের বিপক্ষে দুই দফায় সুযোগ পেয়েছিলেন বটে, তবে সে অভিজ্ঞতা তেমন সুখকর ছিল না। ২০১৪ সালে কামব্যাকের পর খেলা সবশেষ ৪ টেস্টে গম্ভীরের সংগ্রহ এক ফিফটিতে ১৬.৬২ গড়ে মাত্র ১৩৩ রান।

এবার আসি আইপিএল প্রসঙ্গে। ২০০৮-১০ সাল পর্যন্ত আইপিএলে গম্ভীর খেলেছেন নিজ শহরের দল দিল্লি ডেয়ারডেভিলসের হয়ে। ২০১১ সালে আইপিএল ইতিহাসের সবচেয়ে দামী ক্রিকেটার হিসেবে গম্ভীরকে দলে ভেড়ায় শাহরুখ খানের দল কলকাতা নাইট রাইডার্স। ২০১২ সালে গম্ভীরের নেতৃত্বেই চেন্নাই সুপার কিংসকে হারিয়ে প্রথমবারের মত আইপিএল শিরোপা ঘরে তোলে কলকাতা নাইট রাইডার্স। ২০১৪ আইপিএলে কেকেআরকে আবারও শিরোপা এনে দেন গম্ভীর। তবে ২০১৫-১৭ টানা তিন আসরে ভরাডুবির দায়ে গত বছর স্কোয়াড থেকে গম্ভীরকে ছেঁটে ফেলে কেকেআর কর্তৃপক্ষ। গম্ভীর ফিরে যান পুরনো দল দিল্লি ডেয়ারডেভিলসে। কিন্তু বাজে ফর্মের কারণে গত আসরের মাঝপথেই অধিনায়কত্ব থেকে সরে দাঁড়ান তিনি। জায়গা হারান একাদশ থেকেও।

চলুন এক নজরে দেখে নিই গৌতম গম্ভীরের আন্তর্জাতিক ক্যারিয়ার পরিসংখ্যান।

টেস্ট: ৫৮টি টেস্ট খেলে ৪১.৯৫ গড়ে করেছেন ৪১৫৪ রান। সর্বোচ্চ ২০৬, বিপক্ষ অস্ট্রেলিয়া। ৯টি সেঞ্চুরির পাশাপাশি রয়েছে ২২টি হাফ সেঞ্চুরি।

ওয়ানডে: ১৪৭টি ওয়ানডে খেলে ৩৯.৬৮ গড়ে করেছেন ৫২৩৮ রান। সর্বোচ্চ অপরাজিত ১৫০*, বিপক্ষ শ্রীলঙ্কা। ১১টি সেঞ্চুরির পাশে হাফ সেঞ্চুরি আছে ৩৪টি।

আন্তর্জাতিক টি২০: ৩৭ ম্যাচে ২৭.৪১ গড়ে গম্ভীরের সংগ্রহ ৯৩২ রান। সর্বোচ্চ ৭৫, বিপক্ষ পাকিস্তান। হাফ সেঞ্চুরি হাঁকিয়েছেন ৭টি।

বেশ ক'বছর ধরেই আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে অনিয়মিত তিনি। ব্যাট হাতে সাম্প্রতিক ফর্মটাও ভাল যাচ্ছে না। দিল্লির হয়ে রঞ্জি ট্রফিতেও এ বছর ব্যাটে রান আসেনি তেমন। দিল্লি ফ্র্যাঞ্চাইজির হয়ে ব্যর্থ আইপিএলেও।  দীর্ঘ ১৮ বছরের ক্রিকেট জীবনকে বিদায় জানানোর এটাই হয়ত উপযুক্ত সময়। হয়ত ক্রিকেটকে দেবার মত আর কিছুই অবশিষ্ট নেই তাঁর কাছে। বাকিটা গম্ভীরের মুখ থেকেই শুনুন, “As a batsman I have always valued timing. I know the time is just right. I am sure its sweet as well.”