ক্রিকেট লিজেন্ডস

ল্যান্স ক্লুজনারঃ দ্য গেইম চেইঞ্জার

ক্রিকফ্রেঞ্জি করেসপন্ডেন্ট

ক্রিকফ্রেঞ্জি করেসপন্ডেন্ট
প্রকাশের তারিখ: 14:50 শুক্রবার, 30 নভেম্বর, 2018

|| ফ্রাইডে স্পেশাল ||

ক্রিকেট ইতিহাসের সবচাইতে পাওয়ারফুল হার্ডহিটারদের একজন মনে করা হয় তাঁকে। লোয়ার অর্ডারে কার্যকরী ব্যাটিং আর বুদ্ধিদীপ্ত মিডিয়াম পেস বোলিং দিয়ে যেকোন মুহূর্তে যিনি ঘুরিয়ে দিতে পারতেন খেলার মোড়। আনঅর্থোডক্স টেকনিক,  নিখুঁত পিঞ্চ হিটিং আর বেসবল স্টাইলের 'হাই ব্যাকলিফট' যার ব্যাটিংয়ে এনে দিয়েছিল ভিন্ন এক মাত্রা। এমন একজন ক্রিকেটার তিনি যাকে নতুন করে পরিচয় করিয়ে দেবার কিছুই নেই। বলছিলাম '৯৯ বিশ্বকাপের ট্র্যাজিক হিরো, ওয়ানডের সর্বকালের অন্যতম সেরা অলরাউন্ডার ল্যান্স ক্লুজনারের কথা; সতীর্থদের কাছে যিনি পরিচিত ছিলেন 'জুলু' নামে।

নিজের দিনে ক্লুজনার ছিলেন একজন সত্যিকারের ম্যাচ উইনার। কঠিন পরিস্থিতিতে চাপের মধ্যেও মাথা ঠান্ডা রেখে ম্যাচ বের করে নিয়ে আসার ক্ষমতা ছিল তাঁর মধ্যে। আবার প্রয়োজনের সময় বল হাতে দলকে এনে দিতেন কাঙ্খিত ব্রেকথ্রু। ফিনিশার হিসেবে ছিলেন দুর্দান্ত। নিশ্চিত হারতে থাকা অনেক ম্যাচও জিতিয়েছেন একা হাতে। তাঁর ৩০-৪০ রানের ছোট ছোট ইনিংসগুলোও ম্যাচ জয়ে বড় প্রভাবক হিসেবে কাজ করত। উইজডেনের ভাষায়, “Klusener would finish matches at will, no matter what the situation was.”

মজার ব্যাপার হল, ক্লুজনার ক্যারিয়ার শুরু করেছিলেন একজন জেনুইন ফাস্ট বোলার হিসেবে। শুনলে অবাক হবেন যে তাঁর ফার্স্ট ক্লাস অভিষেক হয়েছিল ১১ নম্বর ব্যাটসম্যান হিসেবে!

ক্লুজনারের বোলিং এ্যাকশনটা ছিল দেখার মত। কিছুটা ব্যতিক্রমধর্মী হওয়ায় সহজেই নজর কাড়ত। রানআপের শুরুতে ছোট্ট একটা লাফ দিতেন তিনি। ডান হাতটা চোখের সামনে এমনভাবে ধরে রাখতেন যেন দেখে মনে হত একটা লক্ষ্য স্থির করে বলটা সেখানে ঠিকঠাক ফেলতে চাইছেন।

১৯৯৬ সালের জানুয়ারিতে দক্ষিণ আফ্রিকার হয়ে রঙিন জার্সিতে অভিষেক, ইংল্যান্ডের বিপক্ষে। তার কয়েক মাস পরই টেস্ট ডেব্যু, নভেম্বরে ভারতের বিপক্ষে। একাদশে ঢুকেছিলেন সাবেক পেসার ফ্যানি ডি ভিলিয়ার্সের রিপ্লেসমেন্ট হিসেবে।  

কলকাতার ইডেন গার্ডেন্সে অভিষেক টেস্টের শুরুটা অবশ্য ছিল ভুলে যাবার মত। ভারতীয় অধিনায়ক মোহাম্মদ আজহারউদ্দীনের হাতে খেয়েছিলেন বেধড়ক পিটুনি। ক্লুজনারের এক ওভারে টানা ৫টি চার মেরেছিলেন আজহার। প্রথম ইনিংসে ১৪ ওভার বল করে রান দিয়েছিলেন ৭৫।

তবে দ্বিতীয় ইনিংসে বল হাতে পেয়েই তিনি ঘুরে দাঁড়িয়েছিলেন অবিশ্বাস্যভাবে; মাত্র ৬৪ রানের বিনিময়ে ৮ উইকেট তুলে নিয়ে দলকে উপহার দিয়েছিলেন অবিস্মরণীয় এক জয়; অভিষেকেই হয়েছিলেন ম্যাচসেরা।

অভিষেক টেস্টেই এমন বিধ্বংসী বোলিংয়ের সৌজন্যে ক্লুজনার ঠাঁই করে নেন রেকর্ড বুকেও। দক্ষিণ আফ্রিকার হয়ে টেস্ট অভিষেকে সেরা বোলিংয়ের রেকর্ডটি (৮/৬৪) আজও কেউ ভাঙতে পারে নি।

একই বছর ডিসেম্বরে ক্যারিয়ারের মাত্র 'তৃতীয়' ওয়ানডে খেলতে নেমে হয়েছিলেন ম্যান অফ দ্য ম্যাচ। অস্ট্রেলিয়ার বিরুদ্ধে খেলেছিলেন ৭৯ বলে অপরাজিত ৮৮ রানের একটি অনবদ্য ইনিংস।

১৯৯৭ সালের জানুয়ারিতে ক্যারিয়ারের মাত্র চতুর্থ টেস্টেই হাঁকিয়ে বসলেন দুর্দান্ত এক সেঞ্চুরি। কেপটাউনে ভারতের বিপক্ষে ৯ নম্বরে নেমে খেললেন ১০০ বলে ১০২ রানের হার না মানা একটি ইনিংস। 

একই বছর নভেম্বরে উইলস চারজাতি টুর্নামেন্টে শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে পরপর দুই ম্যাচে ম্যাচসেরা হয়ে আলোচনায় উঠে আসেন ক্লুজনার। প্রথম ম্যাচে ৫৪ রান (৪১ বলে) এবং ৬ উইকেট (৪৯ রানে)। দ্বিতীয় ম্যাচে ৯৯ রান (৯৬ বলে) এবং ২ উইকেট (২৮ রানে)।

মাসখানেক পর অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে ওয়ানডে সিরিজেও দুইবার ম্যাচসেরা হন তিনি। দুই ম্যাচের একটি জিতিয়েছিলেন বল হাতে (২৪ রানে ৫ উইকেট), অন্যটি ব্যাট হাতে (১১৮ বলে ৯২ রান)।

১৯৯৮ সালের এপ্রিলে ওয়ানডে ক্যারিয়ারে তৃতীয়বারের মত বল হাতে শিকার করেছিলেন ৫ উইকেট। কেপটাউনের নিউল্যান্ডসে মাত্র ৭.১ ওভারের বিধ্বংসী এক স্পেলে গুঁড়িয়ে দিয়েছিলেন পাকিস্তানি টপ মিডল অর্ডার। ২৫ রানে ৫ উইকেট নিয়ে হয়েছিলেন ম্যাচসেরা।

১৯৯৯ সালের মার্চে নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে অবিশ্বাস্য এক ম্যাচ জিতিয়েছিলেন ক্লুজনার। ৪০ ওভারে ১৯২ রানের লক্ষ্যে খেলতে নেমে এক পর্যায়ে ৮ উইকেট হারিয়ে বসে প্রোটিয়ারা। জয়ের জন্য শেষ বলে দরকার ছিল ৪ রান। কিউই পেসার ডিওন ন্যাশের করা বলটিতে বিশাল এক ছক্কা হাঁকিয়ে খেলা শেষ করেন ক্লুজনার; অপরাজিত থাকেন ১৯ বলে ৩৫ রানে।

১৯৯৯ বিশ্বকাপটা ছিল ক্লুজনারের ক্যারিয়ারের উজ্জ্বলতম অধ্যায়। যে টুর্নামেন্টে তিনি আবির্ভূত হয়েছিলেন একজন সত্যিকারের ইম্প্যাক্ট প্লেয়ার হিসেবে। দলের প্রায় প্রতিটি জয়েই রেখেছিলেন বড় অবদান, চারটিতে জিতেছিলেন ম্যাচসেরার পুরস্কার। বল হাতে মাত্র ২০ গড়ে নিয়েছিলেন ১৭ উইকেট আর ব্যাট হাতে ১৪০.৫০ গড়ে করেছিলেন ২৮১ রান। স্ট্রাইক রেট ১২২.৭০! যথারীতি বিশ্বকাপের 'প্লেয়ার অফ দ্য টুর্নামেন্টের' ট্রফিটাও উঠেছিল তাঁর হাতেই।

১৯৯৯ বিশ্বকাপে ক্লুজনারের 'ম্যাচ বাই ম্যাচ' পারফরম্যান্সগুলো ছিল —

• ভারতের বিপক্ষে ১২*(৪) ও ১০-০-৫৬-৩
• শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে ৫২*(৪৫) ও ৫.২-১-২১-৩
• ইংল্যান্ডের বিপক্ষে ৪৮*(৪০) ও ৬-০-১৬-১
• কেনিয়ার বিপক্ষে ৮.৩-৩-২১-৫
• জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে ৫২*(৫৮) ও ৯-০-৩৬-১
• পাকিস্তানের বিপক্ষে ৪৬*(৪১) ও ৯-০-৪১-১
• নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে ৪(৫) ও ৯-০-৪৬-২
• অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে ৩৬(২১) ও ১০-০-৫৩-১
• অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে ৩১*(১৬) ও ৯-০-৫০-০

উল্লেখ্য, '৯৯ বিশ্বকাপের দ্বিতীয় সেমিফাইনালটি জন্ম দিয়েছিল ক্রিকেট ইতিহাসের অন্যতম সেরা ট্র্যাজেডির, যেখানে ট্র্যাজিক হিরোর ভূমিকায় ছিলেন ল্যান্স ক্লুজনার!

অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে জয়ের জন্য ১ উইকেট হাতে নিয়ে শেষ ওভারে প্রোটিয়াদের দরকার ছিল ৯ রান। ড্যামিয়েন ফ্লেমিংয়ের প্রথম দুই বলেই বাউন্ডারি হাঁকালেন ক্লুজনার। এদিকে তৃতীয় বলে অল্পের জন্য রানআউটের হাত থেকে বেঁচে যান নন স্ট্রাইকে থাকা ব্যাটসম্যান অ্যালান ডোনাল্ড। ওভারের চতুর্থ বলটা ঠিকমত ব্যাটে বলে করতে পারেন নি। বল সরাসরি চলে যায় ফিল্ডারের হাতে। কিন্তু তবুও কী মনে করে প্রান্ত বদলের জন্য পড়িমরি করে ছুটলেন ক্লুজনার। কিন্তু একি! ডোনাল্ড যে তখনও ক্রিজের ভেতর ঠায় দাঁড়িয়ে, একমনে চেয়ে আছেন বলের দিকে! যতক্ষণে দৌড় শুরু করলেন ততক্ষণে সর্বনাশ যা হবার তা হয়ে গেছে! ক্লুজনারের ১৬ বলে অপরাজিত ৩১ রানের ইনিংসটা হয়ে রইল একটা আক্ষেপের নাম।

প্রখ্যাত ধারাভাষ্যকার বিল লরির মুখ থেকেই শুনুন বাকিটা, "...this will be out surely – oh it's out, it's gonna be run out...oh, that is South Africa out – Donald did not run, I cannot believe it. Australia go into the World Cup Final – ridiculous running with two balls to go. Donald did not go, Klusener came – what a disappointing end for South Africa."

গোড়ালি ও পিঠের ইনজুরির কারণে '৯৯ বিশ্বকাপের পর থেকেই বলের গতি এবং ধার দুটোই হারাতে থাকেন ক্লুজনার। তবে পেস কমে গেলেও অ্যাকুরেসি এবং কন্ট্রোল ঠিকই বজায় রেখেছিলেন। ব্যাটসম্যানের ব্লকহোল বরাবর নিখুঁত ইয়র্কার দিতে পারতেন। আর ছিল স্লোয়ার, অফ কাটারের মত কিছু ভ্যারিয়েশন যা তাঁকে সীমিত ওভারের ক্রিকেটে দারুণ কার্যকরী একজন বোলার হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেছিল।

অনেকেই হয়ত জানেন না, দক্ষিণ আফ্রিকার হয়ে ওয়ানডেতে সবচেয়ে বেশিবার ৫ উইকেট শিকার করা বোলারের নাম ল্যান্স ক্লুজনার (৬ বার)!

'৯৯ বিশ্বকাপের নায়ক ক্লুজনার খেলেছিলেন ২০০৩ বিশ্বকাপেও। দক্ষিণ আফ্রিকা সেবার বাদ পড়েছিল প্রথম পর্ব থেকেই, ক্লুজনারের পারফরম্যান্সও ছিল বিবর্ণ। ৫ ইনিংস খেলে করেছিলেন মাত্র ৯১ রান আর বল হাতে উইকেট পেয়েছিলেন মোটে ৫টা।

১৯৯৬ সালে শুরু, ২০০৪ সালে শেষ। ইনজুরির কারণে ক্যারিয়ারের শেষভাগটা কেটেছে ফর্মহীনতায়। তবে এই সংক্ষিপ্ত ক্যারিয়ারেই ব্যাট হাতে ছোট-বড় অসংখ্য 'গেম চেঞ্জিং' নক উপহার দিয়েছেন ক্লুজনার। ওয়ানডেতে ১৯ বার জিতেছেন ম্যাচসেরার পুরস্কার।

ওয়ানডেতে অসংখ্য জয়ের নায়ক, বাঁহাতি ক্যারিশম্যাটিক হার্ডহিটার ক্লুজনার ব্যাট হাতে অবদান রেখেছেন টেস্ট জয়েও। ভারতের বিপক্ষে ১০৮ এবং ইংল্যান্ডের বিরুদ্ধে ক্যারিয়ার সেরা ১৭৪ রানের ইনিংসটির কথা না বললেই নয়। তবে সবচাইতে উল্লেখযোগ্য অবদানটা রেখেছিলেন সম্ভবত শ্রীলঙ্কার বিরুদ্ধে 'ঐতিহাসিক' ক্যান্ডি টেস্টে।

২০০০ সালে শ্রীলঙ্কার মাটিতে দক্ষিণ আফ্রিকার প্রথম টেস্ট জয়ের নায়ক ছিলেন ল্যান্স ক্লুজনার। ক্যান্ডিতে ক্লুজনারের ২১৯ বলে ১১৮ রানের 'এক্সট্রা-অর্ডিনারি' ইনিংসের সৌজন্যেই মাত্র ৭ রানের নাটকীয় এক জয় পেয়েছিল প্রোটিয়ারা।

ভাস-মুরালির বোলিং তোপে প্রথম ইনিংসে মাত্র ৩৪ রানে ৫ উইকেট হারিয়ে রীতিমতো মুখ থুবড়ে পড়েছিল দক্ষিণ আফ্রিকা। সেখান থেকে দলীয় স্কোর আড়াইশ'র ওপর নিয়ে যাওয়ার পুরো কৃতিত্বটাই ছিল ক্লুজনারের। কেবল তা-ই নয়, লঙ্কানদের দ্বিতীয় ইনিংসে বল হাতে ২টি গুরুত্বপূর্ণ ব্রেকথ্রুও এনে দিয়েছিলেন তিনি।

২০০০ সালে উইজডেন কর্তৃপক্ষ তাদের বর্ষসেরা ক্রিকেটার হিসেবে নির্বাচিত করেছিল ল্যান্স ক্লুজনারকে।

আসুন এক নজরে দেখে নিই ল্যান্স ক্লুজনারের আন্তর্জাতিক ক্যারিয়ার পরিসংখ্যান।

#টেস্ট:

৪৯ ম্যাচে ৩২.৮৬ গড়ে ১৯০৬ রান। সেঞ্চুরি ৪টি, ফিফটি ৮টি। সর্বোচ্চ ১৭৪, ইংল্যান্ডের বিপক্ষে।

এছাড়া বল হাতে নিয়েছেন ৮০ উইকেট। সেরা বোলিং ৮/৬৪, ভারতের বিপক্ষে।

#ওয়ানডে:

১৩৭ ইনিংসে ৪১.১০ গড়ে ৩৫৭৬ রান। স্ট্রাইক রেট ৮৯.৯২। সেঞ্চুরি ২টি, ফিফটি ১৯টি। সর্বোচ্চ ১০৩*, নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে।

এছাড়া বল হাতে উইকেট নিয়েছেন ১৯২টি। সেরা বোলিং ৬/৪৯, শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে।

শেষ করব একটি মজার তথ্য দিয়ে। দক্ষিণ আফ্রিকার প্রধান দশটি ভাষার একটি হচ্ছে 'জুলু'। সেখানে জুলু ভাষাভাষী মানুষের সংখ্যা প্রায় ১০ মিলিয়ন। ক্লুজনার ছিলেন তাদেরই একজন। 'জুলু' ভাষায় অনর্গল কথা বলতে পারতেন বলে সতীর্থরা তাঁর নাম দিয়েছিল 'জুলু'। মজার ব্যাপার হল, দক্ষিণ আফ্রিকার বর্ণবাদবিরোধী প্রয়াত নেতা ও কিংবদন্তি রাষ্ট্রনায়ক নেলসন ম্যান্ডেলার মাতৃভাষাও ছিল জুলু।