বিশেষ সাক্ষাৎকার

পোড় খাওয়া দল বলেই বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ উজ্জ্বলঃ ক্যাম্পবেল

জুবাইর

জুবাইর
প্রকাশের তারিখ: 23:58 শনিবার, 27 অক্টোবর, 2018

|| ক্রিকফ্রেঞ্জি করেসপন্ডেন্ট ||

সাবেক জিম্বাবুয়ে অধিনায়ক অ্যালিস্টার ক্যাম্পবেল তাঁর দেশের সোনালি প্রজন্মের ক্রিকেটারদের একজন ছিলেন। ১১ বছরের ক্যারিয়ারে ৬০ টেস্ট ও ১৮৮ ওয়ানডে ম্যাচ খেলা ক্যাম্পবেল পরিচিত ছিলেন তাঁর আগ্রাসী ব্যাটিংয়ের জন্য। তাঁর সময়ের সেরা বোলারদের বিপক্ষে উইকেটের চারপাশে শট খেলার মুনশিয়ানা দেখিয়েছিলেন এই বাঁহাতি ব্যাটসম্যান।

২০০৩ সালে ক্রিকেটকে বিদায় জানালেও প্রিয় খেলা থেকে কখনই দূরে ছিলেন না প্রায় আট হাজারের মত আন্তর্জাতিক রান করা অ্যালিস্টার ক্যাম্পবেল। অবসরের পর ক্রিকেট বোর্ডের দায়িত্বে ছিলেন,বর্তমানে ধারাভাষ্যকারের দায়িত্ব পালন করছেন... কখনই ক্রিকেটের সাথে সম্পর্ক ছিন্ন হয়নি এই ৪৬ বছর বয়সী সাবেক ক্রিকেটারের। চলমান বাংলাদেশ-জিম্বাবুয়ে সিরিজেও ধারাভাষ্যকার হিসেবে তাঁর খেলোয়াড়ি জীবনের অভিজ্ঞতা কাজে লাগাচ্ছেন তিনি। কাজের ফাঁকেই ক্রিকফ্রেঞ্জির বিশেষ সাক্ষাৎকারে বিভিন্ন ক্রিকেটীয় দিক বিস্তর আলোচনা করেছেন অ্যালিস্টার ক্যাম্পবেল। 

ক্রিকফ্রেঞ্জিঃ ধারাভাষ্যকারের দায়িত্ব কেমন উপভোগ করছেন?

অ্যালিস্টারঃ খেলার সময়টা মিস করি। প্রতিযোগিতা, মাঠের লড়াই এইসব তো সবসময় থাকে না। দলের সদস্যদের সাথে মাঠে ক্রিকেট খেলা সবসময়ই ভাল অভিজ্ঞতা ছিল। কিন্তু যেই কঠোর পরিশ্রমটা করতে হত, আপনার বয়স বাড়ার সাথে সেটা খুব একটা মিস করবেন না, জিম, রানিং, অনুশীলন এবং ওয়ার্ম আপ, এইসব আর কি। আর সফর করা, বিমানে চড়া, হোটেল জীবন, ঘরের বাইরে সময়ে দীর্ঘ সময় কাটানো, এইসব ব্যাপার মোটেও নেতিবাচক কিছু নয়। আমরা আবার এখনকার ক্রিকেটারদের মত এত ক্রিকেট খেলতাম না।

বিশ্ব জুড়ে এত টি-টুয়েন্টি লীগ চলছে, ক্রিকেটাররা সবসময়ই খুব ব্যস্ত থাকে। তাদের বেশীরভাগ সময় পরিবারের বাইরে সময় কাটাতে হয়। তবে যোগাযোগের মাধ্যমে অনেক উন্নতি এসেছে। দেশের বাইরের সফরের নিয়মকানুনেও পরিবর্তন এসেছে। এখন দল গুলো ক্রিকেটারদের তাঁর পরিবার সহ সফর করতে দেয়। বেশির ভার সময় পরিবারকে এখন ক্রিকেটারদের সাথে সফর করতে দেখা যায়। আমাদের সময় এটা ছিল না। আমার মনে আছে, শ্রীলঙ্কায় সফর করার আগে আমার স্ত্রীর সিজার করাতে হয়েছিল, যাতে সফরে যাওয়ার আগেই আমি আমার নবজাতককে দেখে যেতে পারি। আমাদের সময়ে ক্রিকেটটা এমনই ছিল, ক্রিকেট প্রথম, বাকি সব দ্বিতীয়। এখন অনেক পরিবর্তন এসেছে, যা ক্রিকেটারদের জন্য ভাল। 

ক্রিকেট ক্যারিয়ার শেষে বেশীরভাগ ক্রিকেটারই চায় কোন না কোন ভাবে ক্রিকেটের সাথে সংযুক্ত থাকতে। সেটা ধারাভাষ্যকার, কোচিং, আম্পায়ারিং, মিডিয়া কিংবা অবকাঠামোগত কাজে হোক, সবাই চায় প্রিয় খেলার সাথে জড়িত থাকতে। আমি ধারাভাষ্য পছন্দ করেছি। আমি বোর্ডের সাথে পরিচালনায় কাজ করেছি। আমি শুধু খেলার সাথে জড়িত থাকতে চেয়েছি। দীর্ঘ সময় ধরে জীবনের বড় অংশ জুড়ে ছিল ক্রিকেট, আপনি চাইবেন জেভাবেই হোক ক্রিকেটের সাথেই জড়িত থাকতে। এভাবেই আপনি ক্রিকেটের চাহিদা মেটাতে পারেন। সবাই অবশ্য অবসরের পর ক্রিকেটের সাথে জড়িত থাকে না। তাঁরাও কিন্তু পেপার পত্রিকা খুলে ক্রিকেটের খবরটা সবার আগে খুঁজে নেয়। সুতরাং আপনি কখনই সম্পূর্ণ ক্রিকেট থেকে দূরে সরে যান না। 

ক্রিকফ্রেঞ্জিঃ উপমহাদেশে আপনার রেকর্ড খুবই ভাল। তখনকার সময়ের জিম্বাবুয়ে ব্যাটসম্যানদের মধ্যে আপনি অন্যতম সেরা ছিলেন, স্পিনের বিপক্ষে খেলার ক্ষেত্রে। এখন জিম্বাবুয়ের ব্যাটসম্যানরা স্পিনেই কুপকাত হচ্ছে। এই সময়ে কি পরিবর্তন এসেছে? 

অ্যালিস্টারঃ ফলাফল আসলে চোখের সামনেই। আপনি তুলনা করতে চাইবেন, দুই প্রজন্মের। পরিসংখ্যান বলছে আমাদের প্রজন্ম ভাল করেছে। আমাদের দলে বেশ কয়েকজন দারুন ব্যাটসম্যান ছিল, যারা স্পিনের বিপক্ষে দক্ষ ছিল। আমরা তাদের কাছ থেকে শিখতে পেরেছি। অ্যান্ডি ফ্লাওয়ার, ডেভ হাওটন, আমরা তাদের কাছ থেকে শিখতে পেরেছি। আমাদের সময়ের সৌন্দর্য ছিল এইসবই। আমরা মেন্টর পেয়েছি, শেখার জন্য। ডেভ হাওটন আমাদের ক্লাব দলেই খেলেছিল। তিনিই মূলত আমাকে শিখিয়েছেন, কিভাবে স্পিন খেলতে হয়। কোথায় রান করতে হয়, কিভাবে করতে হবে, এইসব ব্যাপার। আমি তাঁর প্রতি কৃতজ্ঞ থাকব সবসময়। দলে যখন স্পিনের বিপক্ষে আত্মবিশ্বাসী ব্যাটসম্যান থাকবে, তাহলে বাকিদের মধ্যেও সেই আত্মবিশ্বাস ছড়িয়ে পড়ে। 

জিম্বাবুয়ে ক্রিকেটের এই প্রজন্ম অনেক উত্থান পতনের মধ্য দিয়ে গিয়েছে। তাঁরা সফল দল নয় এবং তাদের ফলাফল সবার সামনে আছে। কিন্তু এই দলে কিছু ব্যাটসম্যান আছে, যারা স্পিন ভাল খেলে। ব্রেন্ডন টেইলর একজন দারুন ব্যাটসম্যান, স্পিনের বিপক্ষে তাঁর রেকর্ডও ভাল। শন উইলিয়ামস, সিকান্দার রাজা স্পিন ভাল খেলে থাকে। এই দলটি শ্রীলঙ্কায় ৩-২ ব্যবধানে সিরিজ জয় করেছিল এবং সেখানে তাঁরা স্পিন ভাল খেলেছে। তাঁরা দারুন কিছু মুহূর্তের জন্ম দিতে পেরেছে, কিন্তু তাঁরা ধারাবাহিক ছিল না যতটা না আমরা ছিলাম। আমরা অবশ্য এখানে (উপমহাদেশে) অনেক ক্রিকেট খেলেছি। আমরা পাকিস্তান, শ্রীলঙ্কা, ভারতে সফর করেছি। বাংলাদেশে এসেছি কয়েকবার। আমরা উপমহাদেশে অনেক সময় কাটিয়েছি। এখানে রান করার উপায় বের করতে হয়েছে আমাদের। প্রতিযোগিতা করতে হলে এবং সফল হতে হলে আর কোন উপায় নেই। এই কন্ডিশনে অনেক বেশি খেললে কাজটা সহজ হয়ে যায়। 

ক্রিকফ্রেঞ্জিঃ স্পিন ভাল খেলার ফর্মুলা কী?

অ্যালিস্টারঃ প্রথমত আপনাকে স্পিন খেলার ফর্মুলা ঠিক করতে হবে, আপনি কিভাবে খেলতে চান। আপনি যখন ফর্মুলা ঠিক করে ফেলবেন, তখন অনুশীলনের মাধ্যমে ঝালিয়ে নেয়ার প্রয়োজন পড়ে। অনুশীলনের প্রস্তুতি ম্যাচে প্রতিফলিত করার ক্ষেত্রে আত্মবিশ্বাস রাখতে হবে। 

আমরা যখন অস্ট্রেলিয়া সফরে গিয়েছিলাম, তখন জাস্টিন ল্যাঙ্গার আমাদের অ্যান্ডি ফ্লাওয়ারকে ফোন দিয়েছিল, জিজ্ঞেস করেছি তাঁর বিখ্যাত সুইপ শটের ব্যাপারে। আমরা মাত্র ভারত থেকে এসেছি, অস্ট্রেলিয়ার ভারত সফর ছিল আসন্ন। তখন ল্যাঙ্গার স্পিন শটে ভারতিয় স্পিনারদের বিপক্ষে রান তুলতে চেয়েছিলেন। ম্যাথু হেইডেন ২০০১ সালে একই কাজ করেছিল, সুইপ শটে অনেক রান করেছিলেন তিনি। মানুষের ভুল ধারনা, নেটে অনুশীলন করেই স্পিনের বিপক্ষে সফল হওয়া যায়। আপনাকে শত শত বার খেলতে হবে, স্পিনে সফল হওয়ার জন্য। যখন সুইপ করার কথা হয়, লেন্থ বিবেচনা করে সুইপ শট খেলতে হয়, লাইন নয়। অনেক ধরনের সুইপ শট আছে। কিন্তু সুইপ শটে হাত পাকাতে অনুশীলনের কোন বিকল্প নেই। আপনাকে পা ব্যবহার করে খেলতে হবে। যখন ব্যাটসম্যান পা ব্যবহার করে খেলা শুরু করে, তখন বোলারের লেন্থ এলোমেলো হয়ে যায়। আপনি যদি বোলারদের এক জায়গায় বল করতে দিতে থাকেন, তাহলে বোলাররা ভাল জায়গা খুঁজে নিয়ে নিয়মিত বোলিং করে যাবে। আপনি যদি স্পিনের বিপক্ষে পা ব্যবহার করে এবং সুইপ শটে স্পিন খেলে থাকেন, তাহলে আপনি রান করার অনেক বেশি সুযোগ পাবেন। আউট হওয়ার ভয় সবসময় মনের কোনে থাকবে। ভয় মস্তিস্ক থেকে বিতাড়িত করতে হবে।

ক্রিকফ্রেঞ্জিঃ আপনি ল্যাঙ্গার-ফ্লাওয়ারের ফোনালাপের কথা বললেন, এখনকার যুগের ক্রিকেটাররা কি এমন যোগাযোগ রক্ষা করে থাকে?

অ্যালিস্টারঃ আপনি যেই দেশে খেলতে যাচ্ছেন, অবশ্যই সেই দেশের কোন ক্রিকেটারকে ফোন করবেন না। ল্যাঙ্গার ফ্লাওয়ারকে ফোন দিয়েছিলেন, কারণ আমরা সদ্য ভারত সফর শেষ করে এসেছি এবং অস্ট্রেলিয়া দল ভারত সফরের প্রস্তুতি নিচ্ছিল। এটা একধরনের পেশাদারী মনোভাব থেকে আসে। আমার মনে হয় না এখন এই ধরনের সম্পর্ক রয়েছে ক্রিকেটারদের মধ্যে। আর এখন আর প্রয়োজনও পড়ে না। এখন ভিডিও ও ডাটার মাধ্যমেই অনেক তথ্য জানা যায়। আপনি চাইলে আপনার অ্যানালিস্টের সাথে বসেই বের করে ফেলতে পারবেন, অ্যান্ডি ফ্লাওয়ার কিভাবে সুইপ শট খেলতেন। নিজের রুমে বসে ইয়উটিউবেও বের করে ফেলা যায় আজকাল। যদি কোন বিশেষ প্লেয়ারের নাম্বার থাকে, যোগাযোগ করার সুযোগ থাকে, তাহলে সবাই তথ্য দিয়ে সাহায্য করতে চাইবে। কিন্তু এখন এইসব হওয়ার কথা না। 

অতীতে আমরা বিপক্ষ দলের ড্রেসিং রুমে গিয়ে সময় কাটাতাম, এক সাথে পানীয় পান করতাম। এইসবও দেখা যায় আজকাল। সেই মিলবন্ধন, প্রতিপক্ষকে দেখে শেখা, আমরা এসব অনেক করে এসেছি। এখন এইসব নেই। ছেলেরা এখন খেলা শেষ করে এসেই মোবাইল ফোনে ব্যস্ত হয়ে পড়ে, টুইটার, ইন্সটাগ্রামে। বলা চলে, দুনিয়া বদলে গেছে। 

ক্রিকফ্রেঞ্জিঃ আপনার কি মনে হয় না, এই বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক ক্রিকেটকে আরও রঙ্গিন করেছিল?

অ্যালিস্টারঃ অবশ্যই, যারা আমাদের সময়ে খেলেছে তাদের জিজ্ঞেস করে দেখুন, তাঁরাও একই কথা বলবে। তাঁরা মাঠে হাড্ডাহাড্ডি লড়াই করতো কিন্তু খেলা শেষে একসাথে সময় কাটাতো। এই মাধ্যমে আমরা প্রতিপক্ষ দলের ক্রিকেটারদের ভাল ভাবে চিনতে পেরেছি। এখন তো সেই সময় নেই। ক্রিকেটাররা এক ম্যাচ খেলেই আরেক ম্যাচের ভেন্যুতে সফর করার জন্য প্রস্তুতি নেয়। আমাদের মত সময়টা তাঁরা পায় না। হ্যাঁ, একই হোটেলে থাকলে হয়তো সকালের খাবারে দেখা হজয়, দুই চার লাইন কথা হয়, কিন্তু সময় করে ক্রিকেট নিয়ে বিস্তর আলোচনা করা, এইসব হয় না আর। হয়তো অ্যাশেজের মত বড় সিরিজ শেষে দুই দল এক সাথে হয়, এছাড়া এমন উদাহরণ পাওয়া যায় না তেমন একটা। আমাদের সময়ের পূর্বে খেলা যাওয়া ক্রিকেটাররা এই ধারা বজায় রেখেছিল, আমরাও রাখতে সক্ষম হয়েছি। কিন্তু এখন আর এমনটা দেখা যায় না। 

ক্রিকফ্রেঞ্জিঃ ১৯৯৯ সালে পাকিস্তানের সাথে ঘরের মাঠে সিরিজ জয় আপনার ক্যারিয়ারের অনেক বড় অর্জন ছিল। সেই অভিজ্ঞতা কেমন ছিল?

অ্যালিস্টারঃ খুবই মধুর স্মৃতি ছিল। আমাদের নিজেদের ভাল ক্রিকেটার ছিল তখন। আমরা জানতাম আমরা লড়াই করতে পারব। আমাদের ভাল করার মত প্লেয়ার ছিল। হ্যাঁ, আমরা সবুজ উইকেটে খেলেছিলাম, যা দুই দলের শক্তির পার্থক্য কমিয়ে দিয়েছিল। আমাদের পেসাররা ভাল বল করেছিল। আমরা যদি ফ্ল্যাট উইকেটে খেলতাম তাহলে তাঁরা রিভার্স সুইং দিয়ে আমাদের হারিয়ে দিতে পারত। তাদের ওয়াসিম, ওয়াকার ও শোয়েবের মত বোলার ছিল। তাঁরা আমাদের জন্য অনেক ভাল দল ছিল। তাদের পেসাররা আমাদের ব্যাটের পাশ দিয়ে গেছে বারংবার। কিন্তু আমাদের পেসাররা কন্ডিশন অনুযায়ী বল করেছে, সফল হয়েছে। তাদের ব্যাটসম্যানদের জন্য কঠিন ছিল। কন্ডিশন আমাদের পক্ষে কথা বলেছে। আর আমরা খুবই ঐক্যবদ্ধ দল ছিলাম। আমরা খেলেছি সত্যিকারের দল হয়ে। 

ক্রিকফ্রেঞ্জিঃ আপনি সফল অধিনায়ক ছিলেন, অধিনায়কত্বে কতোটা পরিবর্তন এসেছে বলে মনে করেন?

অ্যালিস্টারঃ এখন অধিনায়কত্ব অনেকটাই বদলে গেছে। দল গুলো ফরম্যাট অনুযায়ী অধিনায়ক নির্বাচন করে থাকে। ইংল্যান্ডে এখন দেখি ইয়ন মরগান, জো রুট অধিনায়কত্ব করছে। আমাদের সময় কোন টি-টুয়েন্টি ক্রিকেট ছিল না। তাই যে অধিনায়ক সে ওয়ানডে ও টেস্টের অধিনায়কই হবে, এতে কোন সন্দেহ নেই। এখন বিশ্ব জুড়ে টি-টুয়েন্টির প্রভাব থাকায় সবাই সব ফরম্যাটে খেলতে পারে না। আর একেক দেশের অধিনায়কত্বে একেক রকম মতবাদ থাকে। আমি মনে করি, দিন শেষে আপনার দল ভাল তো আপনিও ভাল অধিনায়ক হবেন।

অনেক দলেই দেখা যায় লিডারশিপ গ্রুপ থাকে, সিনিয়র ক্রিকেটারদের নিয়ে। হ্যাঁ, মূল দায়িত্বটা অধিনায়ককেই নিতে হয়। তবে আপনি নেতা হলে ওই গ্রুপের কাছে সাহায্য চাইবেন, তাদের মতামত বিবেচনায় আনবেন। আমার সময় দলে অনেক বড় বড় ক্রিকেটার ছিল, তাদের কাছে আমি সবসময় সাহায্য চেয়েছি। অ্যান্ডি ফ্লাওয়ার, গ্রান্ট ফ্লাওয়ার, ডেভ হাওটন, এরা সবাই আমাকে সবসময় সাহায্য করেছেন। অধিনায়কত্ব সবকিছুর সংমিশ্রণ। কিন্তু নিজের সিদ্ধান্তটা নিজেকেই  নিতে হয়। মাঝে মধ্যে আপনাকে অন্যদের সাহায্য নিতে হবে। কিন্তু আসল কাজটা আপনার। আর চাপের মুখে আপনি শতভাগ মনযোগী নাও থাকতে পারেন। তখন কোচ, বাকি সিনিয়র প্লেয়ারদের মন্তব্য শুনতে হয়। 

ক্রিকফ্রেঞ্জিঃ আপনার সময়ের জিম্বাবুয়ে ক্রিকেট ও এখনকার বাংলাদেশ ক্রিকেটে মিল খুঁজে পান? 

অ্যালিস্টারঃ তুলনা করা যায়, আমরা ২০০০ সালের আগে কখনই বাংলাদেশের কাছে হারি নি। কিন্তু ২০০০ সালের পর থেকে ধীরে ধীরে অবস্থার পরিবর্তন হতে থাকে। বাংলাদেশ দলে এখন সুপার স্টার রয়েছে। সাকিব, তামিমরা আছে, মাশরাফি দলকে দারুনভাবে নেতৃত্ব দিচ্ছে। দলে ভাল স্পিনার রয়েছে। এই দলটা বিশ্বাস করে তাঁরা জিতবে এবং সেটা সর্বোচ্চ পর্যায়ে। আমাদেরও সেই বিশ্বাসটা ছিল। আমাদের যতটা বিশ্বাস করা দরকার ছিল ততটা বিশ্বাস হয়তো নিজেদের সামর্থ্যে রাখি নি। আমাদের আরও কয়েক বছর এক হয়ে খেলা দরকার ছিল। জিম্বাবুয়ে ক্রিকেটে এরপর কি হয়েছে সেটা সবার জানা। আমরা যদি আরও কিছুসময় দল হিসেবে খেলে যেতে পারতাম, কে জানে, এখন হয়তো আমরা এমন অবস্থানে নেমে আসতাম না। 

ক্রিকফ্রেঞ্জিঃ এই বাংলাদেশকে কতোটা সম্ভাবনাময় মনে হয়?

অ্যালিস্টারঃ এই দলের ফলাফল দেখুন, ফলাফলের সাথে তর্ক করা যায় না। চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফি সেমিফাইনাল, এশিয়া কাপ ফাইনালই বলে দেয়া, তাঁরা নিজেদের সামর্থ্যে কতোটা বিশ্বাস রাখে। তাঁরা যদি তাদের সেরা দল নির্বাচন করে বিশ্বকাপে যায়, আগামী বিশ্বকাপে তাদের ভাল সুযোগ থাকবে। ইংলিশ গ্রীষ্ম যদি এবারের মত হয়, তাহলে উইকেট অনেকটা উপমহাদেশের উইকেটের মত আচরণ করবে। বাংলাদেশ দলে মুস্তাফিজুর রহমানের মত বোলার রয়েছে। ব্যাটিংয়ে শক্তি রয়েছে। তাঁরা আবার বেশ কয়েকবার ঝড়ের মধ্য দিয়ে কঠিন পথ পাড়ি দিয়েছে। টপ অর্ডারে ধ্বস নেমেছে, তবুও ঘুরে দাঁড়িয়ে ম্যাচ জিতেছে, ইনজুরি আক্রান্ত দল নিয়ে ভাল করেছে। যখন একটি দল কঠিন জয় অর্জন করতে থাকে, তখন বিশ্বাস চক্রবৃদ্ধি হারে বৃদ্ধি পায়। ভবিষ্যতে একই অবস্থা সামনে সম্মুখীন করলেও তাঁরা সহজে বিশ্বাস হারাবে না, তাঁরা জানবে অতীতে এমন পরিস্থিতিতে পারফর্ম করার অভিজ্ঞতা তাদের আছে। আমি মনে করি এই দলের সবাই ফিট থাকলে বিশ্বকাপে অনেক দূর যাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।

ক্রিকফ্রেঞ্জিঃ জিম্বাবুয়ে ক্রিকেটের পালাবদলকে কিভাবে দেখেন?

অ্যালিস্টারঃ এক সাথে অনেকেই অবসর নিয়েছিল সেই সময়টায়। অনেককে চাকরীচ্যুত করা হয়েছে। এরপর আমাদের ক্রিকেট এক ঝাঁক তরুন ক্রিকেটারের হাতে তুলে দেয়া হয়, কোন ধরনের অভিভাবক ছাড়া। এই তরুন ক্রিকেটারদের একরকম খাঁদের গভীরে ফেলে দেয়া হয়, সেখান থেকে অনেকেই ফিরতে পারেনি। যখন আপনি সবসময়ই হারতে থাকবে, এক সময় আপনি নিজেই নিজের সামর্থ্যে বিশ্বাস হারাতে থাকবেন।

শেষ পর্যন্ত আমরা আমাদের টেস্ট স্ট্যাটাস হারিয়েছি, কারণ আমাদের খেলোয়াড়রা পারিশ্রমিক পাচ্ছিল না। অনেক কিছুই ঘটে গেছে জিম্বাবুয়ে ক্রিকেটে। তবে সবাই চায় জিম্বাবুয়ে ক্রিকেট ফিরে আসুক পূর্বের জায়গায়। সেই জন্য অবকাঠামোগত পরিবর্তন দরকার। আর্থিক সমস্যা ছিল বোর্ডের, আইসিসির বদৌলতে সেই সমস্যা অনেকটাই কেটে গেছে। এখন আমাদের সঠিক জায়গায় সঠিক ব্যক্তিকে বসিয়ে অবকাঠামোগত কাজ গুলো সঠিকভাবে করতে হবে। দলে তরুন প্রতিভাদের সুযোগ করে দিতে হবে।

যেমন ব্রান্ডন মাভুতা, দারুন লেগ স্পিনার, চতুর ব্যাটসম্যান ও ফিল্ডার হিসেবে ভাল। ব্লেসিং মুসারাব্বানি ছিলেন আরেকজন, দুর্ভাগ্য সে কোলপাক চুক্তিতে ইংল্যান্ডে পাড়ি জমিয়েছেন। আমাদের তরুন প্লেয়ার তৈরি করতে হবে এবং তাদের ধরে রাখতে হবে। তাদের ধরে রাখার একমাত্র উপায় ঠিক মত পাওয়া পারিশ্রমিক প্রদান করা। তা না হলে ওরা থাকবে কেন, এটাই স্বাভাবিক। এটা কোন সহজ সমাধান না। একদিনে সাফল্য অর্জন সম্ভবও না। বাংলাদেশ আমাদের অনেক আগেই ছাড়িয়ে গেছে। আফগানিস্তান তো আমাদের থেকে ভাল দল। আয়ারল্যান্ড, নেদারল্যান্ড ও স্কটল্যান্ড, ওরাও ভাল করছে। এই দেশ গুলো তাদের অবকাঠামো গঠনে মন দিচ্ছে। আমরা যদি এখনই জাগ্রত না হই, তাহলে আমরা আরও তলানিতে চলে যাব। 

ক্রিকফ্রেঞ্জিঃ আপনি জিম্বাবুয়ে বোর্ডে ছিলেন, আপনার কি মনে হয়, কোন পথে এগোলে জিম্বাবুয়ে ক্রিকেট আবার প্রতিযোগিতায় ফিরতে পারবে?

অ্যালিস্টারঃ আসলে বোর্ডের আর্থিক সমস্যার সমাধানে আমি খুশি। আইসিসির সহায়তায় সব দেনা পাওয়া মেটানো হয়েছে। এখন তাঁরা অবকাঠামোতে নজর দিতে পারে। নতুন করে কিছু আবিস্কারের দরকার নেই। সব কিছুই আছে জিম্বাবুয়েতে, শুধু সঠিক পথে প্রক্রিয়া চালু হোক। নতুন করে অর্থ সংস্থান করা উচিত প্রতিটি ক্ষেত্রে। আর শুধু বোর্ড একা কাজ করলে হবে না। আমাদের সবাইকে এগিয়ে আসতে হবে। সাবেক ক্রিকেট, স্পন্সর... যে যেভাবে পারে সেভাবেই জিম্বাবুয়ে ক্রিকেটে নিজ পায়ে দাঁড়াতে সাহায্য করা উচিত। প্রক্রিয়াটা আবার নতুন করে চালু হওয়া উচিত। এটা এক রাতেই হবে না। দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনায় সফল হওয়া সম্ভব। লক্ষ্য স্থির করা উচিত, ২০২৩ বিশ্বকাপকে ঘিরে। প্রথম ধাপে আমাদের বিশ্বকাপে কোয়ালিফাই করতে হবে। আমরা সেটা কিভাবে অর্জন করব, সেই অনুযায়ী পরিকল্পনা করা উচিত। সবাই যদি এক হই, র‍্যাঙ্কিংয়ে সেরা আটে জায়গা করে নেয়ার পথে কাজ করি তাহলে ভাল করা সম্ভব। আমি আমার ব্যক্তিগত হাই পারফর্মেন্স ইউনিট চালু করতে যাচ্ছি, এমন সবার এগিয়ে আসা উচিত নিজ নিজ জায়গা থেকে।

ক্রিকফ্রেঞ্জিঃ বিশ্বকাপ বাচাই পর্বের ধাক্কা জিম্বাবুয়ে ক্রিকেটে কেমন প্রভাব ফেলেছে?

অ্যালিস্টারঃ আপনি তিন রান দূরে, বিশ্বকাপে জায়গা করে নেয়ার জন্য। কিন্তু সেই জায়গা থেকে হৃদয়ভাঙ্গা হার, সবার জন্যই এমন হার সহজে নেয়া কঠিন ছিল। আর এরপরের ঘটনা প্রভাবও খুবই তিক্ত ছিল। কোচ, অধিনায়ককে বাদ দেয়া হলো, প্লেয়ারদের বাদ দেয়া হলো। এরপর আর্থিক সমস্যা, প্লেয়ারদের বয়কট, সব কিছু মিলিয়ে ওই সময়টা মোটেও সহজ ছিল না। আশা করি এখন সব পেছনে ফেলে জিম্বাবুয়ে ক্রিকেট সামনে এগিয়েছে। সিনিয়র ক্রিকেটাররা দেশে ফিরে এসেছে, খেলছে দেশের হয়ে। জিম্বাবুয়ে ক্রিকেটকে মানচিত্রে ফেরাতে হলে তাদেরকে বড় দায়িত্ব পালন করতে হবে। আমরা আগামী বিশ্বকাপে খেলব না, এটাই বাস্তবতা। কিন্তু আমাদের পরের বিশ্বকাপের জন্য প্রস্তুত হতে হবে। 

ক্রিকফ্রেঞ্জিঃ জিম্বাবুয়ে ক্রিকেটের সমর্থকরা সবসময় দলকে সাপোর্ট করে আসছে, কিন্তু দল দীর্ঘদিন তাদের কিছুই দিতে পারছে না। তাদের সম্পর্কে কিছু বলুন...

অ্যালিস্টারঃ দেখুন, বিশ্বকাপ বাছাই পর্বের ম্যাচে দর্শকরা দলে দলে মাঠে এসেছে, দলের জন্য উল্লাস করেছে। সবাই চায় তাদের দল ভাল করুক। বাংলাদেশের দিকেই দেখুন না, মাঠ ভরা দর্শক আসছে, দলও সমর্থকদের নিরাশ করছে না। সমর্থকরা সবসময় জয়ী দলকে পছন্দ করবে। কিন্তু জিম্বাবুয়ে ম্যাচ জিতছে না। এখানে কিছু জিনিসে পরিবর্তন আনা দরকার। সেই পরিবর্তন গুলো দৃশ্যমান হওয়া উচিত, যাতে সমর্থকদের হারানো বিশ্বাস ফিরিয়ে আনা যায়।

তাঁরা পরিবর্তন দেখে ও বিশ্বাস করে, তাহলে অবশ্যই মাঠ ভর্তি দর্শক দেখা যাবে। কিন্তু যখন তাঁরা আথে আসবে, আমাদের উচিত সমর্থকদের জন্য একটি প্রতিযোগিতা পূর্ণ দল উপহার দেয়া। জিম্বাবুয়ে খেলা পাগল দেশ। যারা একটু উল্লাস করতে চায়, একটু খুশি চায়, এই তো, আর কিছু না। মন খারাপ করে বাড়ি ফিরতে ফিরতে তাঁরা ক্লান্ত। আশা করি সুড়ঙ্গের শেষে কিছুটা হলেও আলোর দেখা পাবে জিম্বাবুয়ে ক্রিকেট, কারণ আইসিসি সম্প্রতি সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিয়েছে। আশা করি সেই আলো দলেও খেলাতেও প্রতিফলিত হবে।