ক্রিকফ্রেঞ্জি স্পেশাল

ঋণের টাকায় মাশরাফিদের সহযোদ্ধা নূর বক্স

জুবাইর

জুবাইর
প্রকাশের তারিখ: 23:59 বুধবার, 24 অক্টোবর, 2018

|| ক্রিকফ্রেঞ্জি স্পেশাল || 

বয়স সত্তর ছাড়িয়েছে। অবয়বে পুরোই বাউল।

মাথায় বাংলাদেশের পতাকায় তৈরি হ্যাট আর হাতে একতারা। 

মিরপুর-সাগরিকা বলুন, সিলেট বলুন স্টেডিয়ামের গ্যালারিতে দিগন্ত জোড়া হাসি নিয়ে উপস্থিত থাকেন নূর বক্স। অভাব-অনটনের সঙ্গে নিত্য লড়াই চললেও টাইগারদের জন্য গলা ফাটানোতে পিছিয়ে নেই এই বৃদ্ধ। 

গত এক যুগ ধরে অপার ভালোবাসা নিয়ে বাংলাদেশ দলের বাহুলগ্না হয়ে ছুঁটছেন তিনি। যে মাঠে মাশরাফিরা যুদ্ধ করেন, গ্যালারিতে তাদের সহযোদ্ধা বনে যান নূর বক্স।

ঝিনাইদহের ডুমুরতলা গ্রামের নূর বক্সের শরীরে বয়সের ভার স্পষ্ট। কিন্তু দেশের ক্রিকেটের প্রতি তাঁর তাড়নার কোন কমতি নেই। 

গত ১২ বছরে ২০১৫ সালে বাংলাদেশ-পাকিস্তান সিরিজ ছাড়া ঘরের মাঠে কোন সিরিজ সরাসরি দেখার সুযোগ হাতছাড়া করেননি নূর বক্স। গ্যালারির ফেরিওয়ালার বাইরেও তাঁর আরেকটি পরিচয় আছে। তিনি একজন বীর মুক্তিযোদ্ধা ।

এক সময় করেছেন সেনাবাহিনীর চাকরি। ১৯৭১ সালে দেশ স্বাধীন করতে জীবন বাজি রেখে লড়েছিলেন তিনি। 

জীবনের শেষ বেলায় এসে ক্রিকেট মাঠে মাথায় জাতীয় পতাকা জড়িয়ে দেশকে সমর্থন দিয়ে যাচ্ছেন, শত বাঁধা উপেক্ষা করে।বলা বাহুল্য, আর্থিক অসঙ্গিতই বড় প্রতিবন্ধকতা। মুক্তিযোদ্ধা ভাতায় পরিবার চালানো নূর বক্সের জন্য বিদেশ সফর ছিল বরাবরই অতিকল্পনার কাছাকাছি। 

কিন্তু মানুষ তাঁর স্বপ্নের চেয়ে বড়, তাই তো জীবনের ভাটার সময়েও ২০১৭ সালে শ্রীলঙ্কার মাটিতে ‘জয় বাংলা’ সিরিজে বাংলাদেশকে সামনে থেকে দেখতে ধার করে শ্রীলঙ্কা সফরের খরচ জোগাড় করেছিলেন। 

সেই ঋণের বোঝা এখনও টানছেন নূর বক্স! প্রতি মাসে মুক্তিযোদ্ধা ভাতা থেকে পাওয়া অর্থের অর্ধেকটাই ঋণ পরিশোধে দিতে হচ্ছে ক্রিকেটে মোহবিষ্ট এই বৃদ্ধকে। চট্রগ্রামের জহুর আহমেদ চৌধুরী স্টেডিয়ামে বাংলাদেশের খেলা দেখতে এসে ক্রিকফ্রেঞ্জির সাথে গল্পে গল্পে এমন অনেক কথাই বলেছেন নূর বক্স।  

'প্রতি ম্যাচে পাঁচ হাজার দুইশ টাকা দিতে হয়, ঋণ পরিশোধে। আমি ভাতা হিসেবে দশ হাজার টাকা পাই। আর ছয় হাজার টাকা পাই সেনাবাহিনীর পেনশন হিসেবে। অনেকে অনেক কথা বলে।'  

'আল্লাহ যদি কপালে ভিক্ষা করতে হবে লিখে রাখত, তাহলে ভিক্ষে করেই খেতে হত। সেটা তো হচ্ছে না। আমার এভাবেই চলে যায়, কেউ কেউ অর্থ দিয়ে সাহায্য করে। গতবার শ্রীলঙ্কায় সৌম্য সরকার লঙ্কান টাকায় পাঁচ হাজার টাকা দিয়েছিল।' 

স্বভাবতই নূর বক্সের পরিবারের সদস্যরা বৃদ্ধ বয়সের এহেন পাগলামিকে প্রশ্রয় দিতে চাইবে না। এবারের জিম্বাবুয়ে সিরিজ দেখার জন্য ঘর ছাড়তে বেশ বেগ পেতে হয়েছে তাঁকে। বাড়ির লোকজনের চোখ ফাঁকি দিয়ে মাত্র নয়শ টাকা নিয়ে ঘর ছেড়েছেন তিনি। তাও আবার হাতের প্রিয় একতারা নষ্ট হয়ে যাওয়ায় একটা বড় অংশ ইতোমধ্যে খরচ হয়ে গেছে।

'এবার এখানে খেলা দেখতে এসেছি, নয়শ টাকা নিয়ে। আগের একতারাটা নষ্ট হয়ে গিয়েছিল। নতুন কিনতে খরচ হলো পাঁচশ টাকার মত। এভাবেই চলছে। মানুষ টাকা দেয়, না হয় চলতে পারতাম না। এখানে থাকছি কমপ্লেক্সে। মাথার দুই পাশে দুটি কয়েল জ্বালিয়ে রাত পার করে দিব, ব্যাস।' 

শত প্রতিকুলতার মাঝেও নূর বক্স লড়ে যান। ভোরের আলোয় দেখেন নতুনের সম্ভাবনা। স্বপ্ন দেখেন বড় কিছুর। বর্তমানে একটা স্বপ্নই মনে লালন করছেন তিনি। তা হলো, আগামী বছর ইংল্যান্ডে অনুষ্ঠিত হতে যাওয়া ওয়ানডে বিশ্বকাপ দেখবেন নিজের চোখে। মাঠে বসে খেলা দেখার মানসিক প্রস্তুতি এখন থেকেই নিয়ে নিচ্ছেন তিনি। শ্রীলঙ্কার মত এবারও ঋণ করে দেশের খেলা দেখতে বিলাত পাড়ি দেয়ার স্বপ্ন দেখছেন তিনি। 

'হ্যাঁ, ধার করবো। এরপর বিশ্বকাপ দেখব। আমি কোন স্পোর্টস অ্যাসোসিয়েশনের সাহায্য পাই না। মাঝে মধ্যে টুকটাক মানুষের সাহায্য পাই, এই যাহ,' ক্রিকফ্রেঞ্জিকে নিজের স্বপ্নের গল্প বলতে থাকেন তিনি।

সাগরিকায় তখন হেলে পড়েছে সূরয। নূর বক্সের চোখেমুখে স্বপ্ন ছোঁয়ার অদম্য মনোবলের রেখা ফুটে উঠছে।