ক্রিকেট লিজেন্ডস

সিডনি বার্নসঃ বোলিংয়ের ব্র্যাডম্যান

ক্রিকফ্রেঞ্জি করেসপন্ডেন্ট

ক্রিকফ্রেঞ্জি করেসপন্ডেন্ট
প্রকাশের তারিখ: 14:50 শুক্রবার, 19 অক্টোবর, 2018

|| ফ্রাইডে স্পেশাল ||

তাঁকে বলা হয় 'বোলিংয়ের ব্র্যাডম্যান'। টেস্ট ইতিহাসের সর্বোচ্চ রেটিং পয়েন্ট (৯৩২) প্রাপ্ত বোলার তিনি। কেবল টেস্ট ক্রিকেট নয়; সব ধরনের ক্রিকেট মিলিয়েই তাঁকে 'সর্বকালের সেরা বোলার' বলে মানেন অনেকেই। তিনি মিডিয়াম পেসার নাকি স্পিনার ছিলেন তা নিয়েও আছে রহস্য। প্রখ্যাত ক্রিকেট লেখক নেভিল কার্ডাস যার সাপের মত ফণা তোলা বিষাক্ত ডেলিভারির নামকরণ করেছিলেন ‘বার্নস-বল’। তিনি হলেন ক্রিকেট ইতিহাসের সবচাইতে স্কিলফুল ও বৈচিত্র‍্যময় বোলার সিডনি ফ্রান্সিস বার্নস।

২৭ টেস্টে মাত্র ১৬.৪৩ গড়ে ১৮৯ উইকেট! অর্থাৎ ম্যাচপ্রতি ৭টি করে উইকেট! স্ট্রাইক রেট মাত্র ৪১.৬৫! অর্থাৎ প্রতিটি উইকেটের জন্য তাঁকে বল করতে হয়েছে ৭ ওভারেরও কম!

এই ছোট্ট ক্যারিয়ারেই তিনি ২৪ বার ইনিংসে ৫ উইকেট আর ৭ বার নিয়েছেন ম্যাচে ১০ উইকেট!

ক্যারিয়ারের বেশিরভাগ সময় মাইনর কাউন্টিতেই খেলেছেন বার্নস। সমসাময়িকদের তুলনায় তাঁর ফার্স্ট ক্লাস ম্যাচের সংখ্যা খুব বেশি না। ১৩৩টি ফার্স্ট ক্লাস ম্যাচে তাঁর শিকার ৭৩৩ উইকেট! গড় মাত্র ১৭.০৯! ইনিংসে ৫ উইকেট পেয়েছেন ৬৮ বার আর ম্যাচে ১০ উইকেট ১৮ বার!

টেস্ট ক্রিকেট, ফার্স্ট ক্লাস, কাউন্টি চ্যাম্পিয়নশীপ, ল্যাঙ্কাশায়ার লীগ, স্টেফোর্ডশায়ার লীগ ও মাইনর কাউন্টি মিলিয়ে বার্নসের ক্যারিয়ারে সর্বমোট উইকেটের সংখ্যাটা ছাড়িয়ে গেছে ৬ হাজার! আরও নির্দিষ্ট করে বললে ৬২২৯! অথচ গড় মাত্র ৮.৩৩! অবিশ্বাস্য বললেও কম বলা হবে!

মাত্র আট গড়ে ছয় সহস্রাধিক উইকেটের এই পরিসংখ্যানই সাক্ষ্য দিচ্ছে, কতটা ভয়ংকর উইকেটশিকারি বোলার ছিলেন সিডনি বার্নস।

সিডনি ফ্রান্সিস বার্নসের জন্ম ১৮৭৩ সালের ১৯ এপ্রিল, ইংল্যান্ডের স্টেফোর্ডশায়ারে। প্রতিযোগিতামূলক ক্রিকেটে হাতেখড়ি ১৮৮৮ সালে, স্মেথউইক ক্রিকেট ক্লাবের হয়ে। মজার ব্যাপার হল, তাঁর পেশাদার ক্রিকেট ক্যারিয়ারের শুরুটা হয়েছিল ডানহাতি অফ স্পিনার হিসেবে! অফ স্পিনের পাশাপাশি লেগ স্পিনের হাতটাও মন্দ ছিল না।

১৮৯৪ সালে প্রথম শ্রেণির ক্রিকেটে অভিষেক, ওয়ারউইকশায়ারের হয়ে। ততদিনে তাঁর পরিচয় একজন পুরোদস্তুর ফাস্ট বোলার। খুব বেশিদিন অবশ্য খেলতে পারেন নি সেখানে। ওয়ারউইকশায়ার ক্লাবের অপেশাদার আচরণের কারণে মাত্র তিন ম্যাচ খেলেই কাউন্টি চুক্তি বাতিল করেছিলেন তিনি। ক্লাবের তরফ থেকে প্রস্তাবিত চুক্তির শর্তাবলী নিয়েও নাখোশ ছিলেন বার্নস।

১৮৯৫ সালে কাউন্টি ক্রিকেট ছেড়ে বার্নস যোগ দেন ল্যাঙ্কাশায়ার লীগের দল রিশটনে। ১৮৯৯ সাল পর্যন্ত সেখানেই কাটিয়েছেন। রিশটনের হয়ে ৩৮ ম্যাচ খেলে পেয়েছেন ৪১১ উইকেট। ১৮৯৮ মৌসুমে মাত্র ৮.৪৬ গড়ে নিয়েছিলেন ৯৬ উইকেট!

ওয়ারউইকশায়ারে থাকতে বার্নস ছিলেন মূলত ফাস্ট বোলার। তবে রিশটন ক্লাবে আসার পর পেস কমিয়ে হয়ে যান মিডিয়াম পেসার। তখন থেকেই পেসের সাথে স্পিন মেশানোর চেষ্টা করতেন বার্নস।

১৯০০ সালে ল্যাঙ্কাশায়ার লীগেরই আরেক ক্লাব বার্নলিতে যোগ দেন সিডনি। ততদিনে অবশ্য ল্যাঙ্কাশায়ারের হয়ে কাউন্টি অভিষেকটাও হয়ে গেছে তাঁর।

বার্নসের টেস্ট অভিষেক ১৯০১ সালে, অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে একরকম হঠাৎ করেই। বার্নসের অপ্রত্যাশিতভাবে টেস্ট দলে ডাক পাওয়ার পেছনের গল্পটাও বেশ ইন্টারেস্টিং। তো চলুন গল্পটা একবার শুনেই আসি।

১৯০১ সালের অ্যাশেজ সফরের জন্য ইংল্যান্ডের অধিনায়ক মনোনীত করা হয় আর্চি ম্যাকলারেনকে। যিনি আবার ছিলেন ল্যাঙ্কাশায়ারেরও অধিনায়ক। দল নির্বাচনের ক্ষেত্রে তাঁকে দেয়া হয়েছিল পূর্ণ স্বাধীনতা।

ফ্রন্টলাইন বোলার হিসেবে আর্চির প্রথম পছন্দ ছিল ইয়র্কশায়ারের বাঁহাতি পেসার জুটি জর্জ হার্স্ট এবং উইলফ্রেড রোডস। কিন্তু ইয়র্কশায়ার সভাপতি লর্ড হক তাঁর দলের সেরা দুই বোলারকে ছাড়তে মোটেও রাজি ছিলেন না। আর্চির তখন হঠাৎ মনে পড়ল বার্নসের কথা। কিছুদিন আগেই না ল্যাঙ্কাশায়ারের হয়ে লেস্টারশায়ারের বিপক্ষে ৭০ রানে ৬ উইকেট নিয়েছিল বার্নস!

ল্যাঙ্কাশায়ারের অধিনায়ক হিসেবে সেই ম্যাচে বার্নসকে খুব কাছ থেকে দেখেছিলেন আর্চি ম্যাকলারেন। যেই ভাবা সেই কাজ! তৎক্ষণাৎ বার্নসকে তিনি ডেকে পাঠালেন জাতীয় দলের নেটে। বার্নসের বোলিংয়ে কিছুক্ষণ ব্যাটও করলেন। বেশিরভাগ বলেই অবশ্য পরাস্ত হয়েছিলেন তিনি। শরীরে আঘাতও পেয়েছিলেন বেশ কয়েক জায়গায়। নেট সেশন শেষে ম্যাকলারেনকে তাই 'সরি' জানাতে ছুটে এসেছিলেন বার্নস। আর এসেই অধিনায়কের মুখ থেকে শুনলেন সুখবরটা! ‘অভিনন্দন বার্নস, তুমি আমার সাথে অস্ট্রেলিয়া যাচ্ছ।’

১৯০১-০২ অ্যাশেজের দলে বার্নসের অন্তর্ভুক্তিকে বলতে হবে একটা বিরাট চমক। মাত্র ৭ ম্যাচের ফার্স্ট ক্লাস অভিজ্ঞতাসম্পন্ন একজন খেলোয়াড়কে কেবল একবার দেখেই দলে নেয়াটাকে স্রেফ পাগলামি বলেও উড়িয়ে দিতে চেয়েছিল অনেকে। উইজডেনের ভাষায়, "the most daring experiment in the history of the game".

সিরিজের প্রথম ম্যাচটা ছিল সিডনিতে। অভিষেক ম্যাচের প্রথম ইনিংসে বার্নস নিলেন ৬৫ রানে ৫ উইকেট। অভিষেকেই পাঁচ উইকেট শিকারের পথে তিনি ফেরালেন বিপক্ষ দুই সেরা ব্যাটসম্যান ভিক্টর ট্রাম্পার ও ক্লেম হিলকে। ইংল্যান্ড জিতল এক ইনিংস ও ১২৪ রানের বিশাল ব্যবধানে!

উল্লেখ্য, বার্নসের সাথে একই ম্যাচে অভিষিক্ত হয়েছিলেন বাঁহাতি স্পিনার কলিন ব্লাইথ এবং লেগ স্পিনার লেন ব্রাউন্ডও। এই তিন ডেব্যুট্যান্ট মিলেই মূলত অস্ট্রেলিয়াকে রীতিমতো ধসিয়ে দিয়েছিল সে ম্যাচে। অস্ট্রেলিয়ার ২০ উইকেটের সবগুলোই জমা পড়েছিল বার্নস (৬), ব্লাইথ (৭) আর ব্রাউন্ডের (৭) ঝুলিতে!

মেলবোর্নে দ্বিতীয় টেস্টে ইংল্যান্ড ২২৯ রানে হেরে গেলেও বার্নস ছিলেন বিধ্বংসী ফর্মে। দুই ইনিংস মিলে একাই নিয়েছিলেন ১৩ উইকেট (৬/৪২ ও ৭/১২১)!

পরের ম্যাচের ভেন্যু ছিল অ্যাডিলেড। কিন্তু দুর্ভাগ্য বার্নসের! হাঁটুর ইনজুরিতে পড়ে ওই সিরিজে আর খেলাই হলো না তাঁর। ক্যারিয়ারের প্রথম অ্যাশেজটা শেষ হয়ে গেল তৃতীয় টেস্টেই।

হাঁটুর ইনজুরি থেকে সেরে উঠতে বার্নসের লেগে গিয়েছিল অনেকটা সময়। পুরোপুরি ফিট না হওয়া সত্ত্বেও ১৯০২ সালে অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে হোম সিরিজের দলে ডাকা হয় বার্নসকে। তবে এক ম্যাচের বেশি খেলতে পারেন নি। ওই এক ম্যাচেই নিয়েছিলেন ৭ উইকেট।

এদিকে ইনজুরি ও ফিটনেসজনিত সমস্যার কারণে ১৯০২ ও ১৯০৩ সালের ফার্স্ট ক্লাস সিজনে নিজের সেরাটা দিতে ব্যর্থ হন বার্নস। ১৯০২ মৌসুমে ২১.৫৬ গড়ে ৯৫ উইকেট আর ১৯০৩ মৌসুমে ১৭.৮৫ গড়ে তিনি নিয়েছিলেন ১৩১ উইকেট।

১৯০৪ সালে বেতন-ভাতা নিয়ে ল্যাঙ্কাশায়ার ক্লাব কর্তৃপক্ষের সাথে দ্বন্দ্বে জড়িয়ে শেষমেশ চুক্তি বাতিল করেন তিনি। ক্লাব ছেড়ে ফিরে আসেন মাইনর কাউন্টিতে। রাগে-অভিমানে জীবনে আর কোনদিন মেজর কাউন্টি চ্যাম্পিয়নশিপে অংশ নেন নি তিনি। যার বিরূপ প্রভাব পড়েছিল তাঁর আন্তর্জাতিক ক্যারিয়ারেও।

একটা তথ্য দিয়ে রাখি, বার্নসের ক্যারিয়ারের শুরু ও শেষের মাঝখানে ইংল্যান্ড টেস্ট খেলেছে মোট ৫৮টি, এর মধ্যে বার্নস খেলতে পেরেছেন মাত্র ২৭টিতে! সেই ২৭ টেস্টেই তাঁর শিকার ১৮৯ উইকেট! ৫৮টার মধ্যে অন্তত ৪০টা টেস্টও যদি খেলতে পারতেন, হয়ত ছাড়িয়ে যেতেন ৩০০ উইকেটের মাইলফলকটাও।

অবশেষে তিনি আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে ফিরলেন তাও প্রায় বছর পাঁচেক পর, ১৯০৭-০৮ সালের এ্যাশেজ দিয়ে। অস্ট্রেলিয়ার কাছে ইংল্যান্ড ১-৪ ব্যবধানে এ্যাশেজ খোয়ালেও ৪ টেস্টে বার্নসের শিকার ছিল ২৬ গড়ে ২৪ উইকেট। প্রত্যাবর্তন সিরিজ হিসেবে খারাপ বলা যাবে না মোটেও।

উল্লেখ্য, সিরিজের যে একটা মাত্র টেস্ট জিতেছিল ইংল্যান্ড, তাতেই বার্নসের ছিল বড় অবদান। বল হাতে দ্বিতীয় ইনিংসে নিয়েছিলেন ৭২ রানে ৫ উইকেট। আর ব্যাট হাতে ১০ নম্বরে নেমে খেলেছিলেন অপরাজিত ৩৮ রানের ম্যাচ 'উইনিং' ইনিংস!

চতুর্থ ইনিংসে ইংল্যান্ডের সামনে লক্ষ্য ছিল ২৮২ রানের। কিন্তু ২৪৩ রান তুলতেই ৯ উইকেট হারিয়ে বসে তারা! এমন অবস্থায় দলকে উদ্ধার করতে এগিয়ে আসেন 'ব্যাটসম্যান' সিডনি বার্নস (৩৮*)। আর্থার ফিল্ডারের (১৮*) সাথে অবিচ্ছিন্ন শেষ উইকেট জুটিতে যোগ করেন ৩৯ রান, দলকে উপহার দেন ১ উইকেটের নাটকীয় এক জয়।

১৯০৯ সালে অজিদের বিপক্ষে হোম সিরিজ। ৩ ম্যাচ খেলে বার্নস নিজের ঝুলিতে পুরলেন ১৭ উইকেট। ইংল্যান্ড পেল 'ব্যাক টু ব্যাক' অ্যাশেজ হারের স্বাদ।

১৯১০ সালে উইজডেন 'ক্রিকেটার অব দ্য ইয়ারের' পুরস্কার জিতেছিলেন সিডনি বার্নস।

১৯১১ সালে অস্ট্রেলিয়ার মাটিতে অস্ট্রেলিয়াকে হারিয়ে (৪-১) অ্যাশেজ শিরোপা পুনরুদ্ধার করে ইংল্যান্ড। ২২.৮৮ গড়ে ৩৪ উইকেট নিয়ে সিরিজের সেরা বোলার ছিলেন সিডনি বার্নস।

১৯১২ সালে অস্ট্রেলিয়া, দক্ষিণ আফ্রিকা ও স্বাগতিক ইংল্যান্ডকে নিয়ে আয়োজিত হয়েছিল ইতিহাসের প্রথম ও একমাত্র ত্রিদেশীয় টেস্ট সিরিজ। পাঁচ ম্যাচে তিনবার ইনিংসে ৫ উইকেটসহ মাত্র ১০.৩৫ গড়ে বার্নসের শিকার ছিল ৩৯ উইকেট! সিরিজ নির্ধারণী শেষ ম্যাচে অস্ট্রেলিয়াকে ২৪৪ রানে হারিয়ে চ্যাম্পিয়ন হয়েছিল স্বাগতিকরাই।

বার্নস তাঁর ক্যারিয়ারের শেষ সিরিজটি খেলেছিলেন ১৯১৪ সালের মার্চে, স্বাগতিক দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে। ৪ টেস্টে ৩ বার ১০ উইকেটসহ মাত্র ১০.৯৩ গড়ে বার্নস একাই নিয়েছিলেন ৪৯ উইকেট! টেস্টে এক সিরিজে সর্বাধিক উইকেট প্রাপ্তির রেকর্ড এটাই; যে রেকর্ড আজ পর্যন্ত কারও পক্ষে ভাঙা সম্ভব হয় নি। দ্বিতীয় স্থানে থাকা জিম লেকার ১৯৫৬ এ্যাশেজে ৫ ম্যাচে নিয়েছিলেন ৪৬ উইকেট।

ওই সিরিজে মোট ৮ ইনিংসে বল করেছিলেন বার্নস, তার মধ্যে ৭ বারই পেয়েছিলেন ৫ বা তার বেশি উইকেট!

বার্নসের ক্যারিয়ার সেরা বোলিং পারফরম্যান্সটা এসেছিল জোহানেসবার্গে, সিরিজের দ্বিতীয় টেস্টে। ১৫৯ রান খরচায় নিয়েছিলেন ১৭ উইকেট! টেস্ট ইতিহাসের সেরা ম্যাচ ফিগারের তালিকায় যার অবস্থান দ্বিতীয়। ৯০ রানে ১৯ উইকেট নিয়ে এক নম্বরে আছেন জিম লেকার।

ডারবানে নিজের শেষ টেস্টেও ১৪ উইকেট পেয়েছিলেন বার্নস; সমান ৭টি করে উইকেট নিয়েছিলেন উভয় ইনিংসেই! 'বার্নস ম্যাজিকে' ভর করে ইংল্যান্ড সেবার হেসেখেলে সিরিজ জিতেছিল ৪-০ ব্যবধানে।

দক্ষিণ আফ্রিকা সফরের পরপরই শুধু হয় প্রথম বিশ্বযুদ্ধ। যে যুদ্ধের ভয়াবহতা ও দাবানলে কেঁপে ওঠে সমগ্র পৃথিবী। স্যার জ্যাক হবস, উইলফ্রেড রোডস, অব্রে ফকনারদের মত সিডনি বার্নসের জীবন থেকেও হারিয়ে যায় ছয়-ছয়টি বছর।

যুদ্ধ যখন শেষ হল, বার্নসের বয়স তখন ৪৭ বছর। ১৯২০-২১ অ্যাশেজের উদ্দেশ্যে অস্ট্রেলিয়া সফরগামী ইংল্যান্ড দলে একবার ডাকাও হয়েছিল বার্নসকে। কিন্তু বার্নস সে প্রস্তাবে সাড়া দেন নি। বার্নস নাকি শর্ত জুড়ে দিয়েছিলেন যে তাঁর স্ত্রী ও সন্তানদেরও সেখানে ভ্রমণ ও থাকা-খাওয়ার ব্যবস্থা করে দিতে হবে। ইংলিশ ক্রিকেট কর্তৃপক্ষ তাতে রাজী না হওয়ায় বেঁকে বসেন বার্নসও। তাঁর আন্তর্জাতিক ক্যারিয়ার কার্যত তখনই শেষ।

জাতীয় দল এবং কাউন্টিতে আর কখনও না খেললেও এত সহজে ক্রিকেট ছাড়ার পাত্র নন বার্নস। স্থানীয় লীগ ও মাইনর কাউন্টিতে খেলা চালিয়ে যান আরও বহুদিন। ওয়েলসের হয়ে পরবর্তীতে ফার্স্ট ক্লাস ক্রিকেটেও অংশ নিয়েছেন তিনি। সবচেয়ে অবাক করা ব্যাপার হচ্ছে, এত বছর খেলেও তাঁর পারফরম্যান্সের ধারাবাহিকতায় কোনদিন এতটুকুও ছেদ পড়ে নি।

বার্নসের ক্রিকেট ক্যারিয়ার সম্পর্কে যতটুকু বলার তা বলে দিয়েছি। এবারে আসি বার্নস কেমন বোলার ছিলেন, কী তার রহস্য সেই প্রসঙ্গে। পেস বিবেচনা করলে সিডনি বার্নস ছিলেন একজন মিডিয়াম পেসার। ঘন্টায় ৭০ থেকে ম্যাক্সিমাম ৮০ মাইল গতিতে বল করতে পারতেন। সাবেক ইংরেজ অলরাউন্ডার স্যার অ্যালেক বেডসারের গতির সাথেও তাঁর সাদৃশ্য খুঁজে পেয়েছেন অনেকে।

সিডনি বার্নস ছিলেন প্রকৃত অর্থেই একজন স্বয়ংসম্পূর্ণ বোলার। বোলিংয়ের বেসিক স্কিল যতগুলো আছে অর্থাৎ সুইং, সিম এবং স্পিন—একাধারে তিনটিতেই পারদর্শী ছিলেন তিনি! অনেকের মতে, বিষাক্ত সুইংয়ের সাথে তিনি নাকি স্পিনের মায়াজাল মেশাতে পারতেন! কি অবাক হচ্ছেন? নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারছেন না? আসলে অবাক হওয়ার কিছু নেই। 

তিনি বলকে দু’দিকেই কথা বলাতে পারতেন অর্থাৎ ইনসুইং, আউটসুইং দুটোতেই ছিলেন সমান পারদর্শী। সবচেয়ে ভয়ঙ্কর ছিল লেট সুইং। আবার নতুন বলের সিমকে কাজে লাগিয়ে যেকোন উইকেট থেকে আদায় করে নিতে পারতেন সিম মুভমেন্ট। এমনকি নিখুঁত ইয়র্কার পর্যন্ত দিতে পারতেন।

পেসার হিসেবে এত এত স্কিল আর কোয়ালিটি থাকা সত্ত্বেও বার্নস নিজেকে একজন 'স্পিনার' হিসেবে পরিচয় দিতেই গর্ববোধ করতেন। তিনি বারবারই বলেছেন, তাঁর সাফল্যের রহস্য ছিল স্পিন।

উইজডেন বলছে, “Barnes was creative, one of the first bowlers really to use the seam of a new ball and combine swing so subtly with spin that few batsmen could distinguish one from the other.”

অস্ট্রেলিয়ার সাবেক বাঁহাতি গ্রেট ক্লেম হিলের মতে, “On a perfect wicket Barnes could swing the new ball in and out "very late", could spin from the ground, pitch on the leg stump and miss the off.”

সিডনি বার্নস পেসার হলেও তাঁর মধ্যে একজন কোয়ালিটি স্পিনারের সবরকম গুণাবলী বিদ্যমান ছিল। তিনি ছিলেন এমন একজন বোলার, যিনি স্বাভাবিকের চেয়ে লম্বা রানআপে দৌড়ে এসে 'স্পিন' বল করতেন।

সবচেয়ে বড় কথা, একই পেসে এবং একই একশনে স্পিন বোলিংয়ের বেসিক ৩টা ডেলিভারিই অর্থাৎ লেগ স্পিন, অফ স্পিন এবং টপ স্পিন করতে পারতেন তিনি, যা তাঁকে বিশ্বের সেরা বোলারের স্বীকৃতি এনে দিয়েছিল।

এ সম্পর্কে উইজডেন বলছে, “With all three balls coming out of the front of the hand at considerable speed it would be almost impossible for the batsman to differentiate between them.”

যেহেতু তিনি বলকে স্পিন করাতে পারতেন সেহেতু তাঁকে একজন স্পিনার বলা যেতেই পারে। তা সিডনি বার্নস ঠিক কোন ধরনের স্পিনার ছিলেন? ফিঙ্গার স্পিনার নাকি রিস্ট স্পিনার? এই প্রসঙ্গে বলব, বার্নসের গ্রিপ ছিল ফিঙ্গার স্পিনারদের মত, কিন্তু বল রিলিজ করতেন ফাস্ট বোলারদের রিস্ট একশনে। রিস্টের কোন রকম রোটেশন ছাড়াই 'ফ্রন্ট অফ দ্য হ্যান্ড' একশনে বলকে টার্ন করাতে পারতেন তিনি।

সবচেয়ে অবাক করা ব্যাপার হল, কব্জি না বাঁকিয়েই কেবলমাত্র আঙুলের সাহায্যেই বলে প্রচুর রেভ্যুলেশন (রোটেশন বা ঘূর্ণনসংখ্যা) ইমপার্ট করতে পারতেন বার্নস। ফলে বাতাসে বল ড্রিফট করত; উইকেট থেকে প্রচুর টার্নও মিলত।

প্রখ্যাত ক্রিকেট সাহিত্যিক নেভিল কার্ডাস যথার্থই বলেছেন, “He fingered a cricket ball sensitively, like a violinist his fiddle.”

তিনি আরও বলেছেন, “Barnes assured me that he actually turned the ball by finger twist.”

শারীরিকভাবে বার্নস ছিলেন বেশ লম্বা (ছয় ফুটেরও বেশি), চওড়া কাঁধ, সুগঠিত বাহু ও সুঠাম দেহের অধিকারী। তাঁর ছিল স্মুথ ইজি রানআপ, হাই রিলিজ পয়েন্ট (অনেকটা ম্যাকগ্রার মত) এবং ফাস্ট আর্ম স্পিড। যার ফলে বল ডেলিভারির সময় চাবুকের বাড়ি দেবার মত এক ধরনের ইফেক্ট (হুইপ ইফেক্ট) তৈরি হত। 'এক্সট্রা লিফট' এবং 'লেট ডিপ' আদায় করে নিতে পারতেন খুব সহজেই।

প্রখ্যাত ক্রিকেটলেখক ও ধারাভাষ্যকার জন আর্লট বলেছেন, “বার্নস ওয়াজ পারফেক্টলি বিল্ট টু বি এ বোলার।”

লাইন-লেন্থের ওপর বার্নসের ছিল অবিশ্বাস্য নিয়ন্ত্রণ, শর্ট বল দিতেনই না বলতে গেলে। সাথে ছিল বুদ্ধিদীপ্ত 'চেঞ্জ অফ পেস'। তাঁর প্রতিটা ডেলিভারির জন্যই ছিল ফাস্টার এবং স্লোয়ার দুই ধরনের ভ্যারিয়েশন।

বার্নস যে শুধু স্কিল, টেকনিক আর বৈচিত্র‍্যেই সেরা ছিলেন তা নয়, তিনি অপ্রতিদ্বন্দ্বী ছিলেন চাতুর্য ও বুদ্ধিমত্তার দিক থেকেও। যেকোন ব্যাটসম্যানের দুর্বলতা পড়ে ফেলতে তাঁর দুই মিনিটও সময় লাগত না। তাঁর বোলিংয়ের একটা উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্য ছিল 'সারপ্রাইজ অ্যাটাক'। সুযোগ বুঝে ব্যাটসম্যানের দুর্বল জায়গায় আঘাত হানতেন তিনি। জন আর্লটের মতে, “বার্নসের প্রতিটা ডেলিভারিই ছিল ব্যাটসম্যানকে ফাঁদে ফেলার অব্যর্থ প্রচেষ্টা, যা একটা সুনির্দিষ্ট কৌশলগত প্যাটার্ন মেনে চলত।”

বার্নস সবচেয়ে বেশি ভয়ঙ্কর ছিলেন আনকভার্ড ভেজা মাটির উইকেটে। তবে ফ্লাট উইকেটেও নিজের সামর্থ্যের প্রমাণ দিয়েছেন অসংখ্যবার। দক্ষিণ আফ্রিকার কৃত্রিম 'ম্যাটিং উইকেটে' তিনি ছিলেন 'প্র‍্যাক্টিক্যালি আনপ্লেয়েবল'!

নেভিল কার্ডাসের ভাষায়, “on matting, Barnes was undoubtedly the most difficult bowler ever evolved by cricket”.

একটা ব্যাপার লক্ষণীয়, বার্নসের সবগুলো ডেলিভারিই ছিল 'ফ্রন্ট অফ দ্য হ্যান্ড' একশনের। 'ব্যাক অফ দ্য হ্যান্ড' একশনে 'গুগলি' দিতে পারতেন না তিনি। অবশ্য তার প্রয়োজনও ছিল না।

এ বিষয়ের বার্নসের ভাষ্য ছিল, "আমি কোনদিনই গুগলি ট্রাই করি নি। আসলে দরকারই হয় নি।"

বার্নসের স্টক ডেলিভারি ছিল 'মিডিয়াম পেসড লেগ ব্রেক'। যা প্রচলিত 'আউটসুইঙ্গার' থেকেও ভয়ঙ্কর ছিল। কেননা বলের গতি থাকত আনুমানিক ৭০ মাইল বা তারও কিছু বেশি। লেগ স্টাম্পের বাইরে পিচ করা বলকে অনায়াসে 'টপ অফ দ্য অফ স্টাম্পে' হিট করাতে পারতেন তিনি। মাঝেমধ্যে নাকি বল এতটাই টার্ন করত যে উইকেটকিপারও নাগাল পেতেন না; সরাসরি স্লিপ ফিল্ডারের কাছে চলে যেত।

বার্নসের বলে 'ক্লিন বোল্ড' হওয়ার পর সাবেক বাঁহাতি গ্রেট ক্লেম হিল একবার বলেছিলেন, "The ball pitched outside my leg-stump, safe to the push off my pads, I thought. Before I could 'pick up' my bat, my off-stump was knocked silly."

গতির কারণে বার্নসের স্পিনিং 'ব্রেক' ডেলিভারিগুলোকে 'কাটার' বলে রায় দিয়েছেন অনেকে। কিন্তু বার্নস তাঁর স্কিলফুল অফ ব্রেক কিংবা লেগ ব্রেকগুলোকে কাটার মানতে নারাজ।

৭০-৭৫ মাইল গতিতে বলে স্পিন ইমপার্ট করা খুবই কঠিন ব্যাপার। অথচ এই কাজটাই দিনের পর দিন অবলীলায় করে যেতে পারতেন বার্নস। একবার কল্পনা করুন তো, মাইক গ্যাটিংকে করা শেন ওয়ার্নের 'শতাব্দীসেরা' ডেলিভারিটা ৭০ মাইল গতিতে করলে কেমন লাগত?

শেষ করা যাক একটি চমকপ্রদ তথ্য দিয়ে। বার্নস তাঁর ক্যারিয়ারের শেষ টেস্ট ম্যাচটি খেলেছেন ১৯১৪ সালে। তার ঠিক ১৪ বছর পর ১৯২৮ সালে ইংল্যান্ড সফরে আসে টেস্ট পরিবারের নবীনতম সদস্য ওয়েস্ট ইন্ডিজ। বার্নসের বয়স তখন ৫৫। আপনাদের বিশ্বাস করতে কষ্ট হচ্ছে জানি, কিন্তু বিশ্বাস করুন ওই ৫৫ বছর বয়সেই ক্যারিবিয়ানদের বিপক্ষে একটা প্রস্তুতি ম্যাচে সত্যি সত্যিই তিনি মাঠে নেমে পড়লেন খেলতে! শুধু খেললেনই না, রীতিমতো জ্বলে উঠলেন বল হাতে। ১১৮ রানে ১২ উইকেট নিয়ে দলকে জিতিয়ে তবেই মাঠ ছাড়লেন তিনি।

অবিশ্বাসের গল্পের এখানেই শেষ নয়। ওই ঘটনার বছর দুয়েক পর দক্ষিণ আফ্রিকা এল ইংল্যান্ড সফরে। একটি প্রস্তুতি ম্যাচের প্রতিপক্ষ ছিল ওয়েলস। বার্নসও ছিলেন সে দলে। যথারীতি বুড়ো হাড়ের ভেল্কি দেখালেন আবারও! ৪১ রানে ৮ উইকেট নিয়ে ৫৭ বছরের 'বৃদ্ধ' বার্নস বুঝিয়ে দিলেন যে ক্রিকেট খেলায় 'ফর্ম ইজ টেম্পোরারি বাট ক্লাস ইজ পার্মানেন্ট'!

আসলে বার্নসের বেলায় শুধু ক্লাস না, ফর্মও ছিল পার্মানেন্ট। তাঁর সম্পর্কে বলা উচিত, “ক্লাস এন্ড ফর্ম বোথ আর পার্মানেন্ট"!