ক্রিকেট লিজেন্ডস

অরবিন্দ ডি সিলভাঃ লঙ্কান ক্রিকেটের ম্যাড ম্যাক্স

ক্রিকফ্রেঞ্জি করেসপন্ডেন্ট

ক্রিকফ্রেঞ্জি করেসপন্ডেন্ট
প্রকাশের তারিখ: 18:50 শুক্রবার, 12 অক্টোবর, 2018

|| ফ্রাইডে স্পেশাল ||

তাঁকে বলা হত বিগ ম্যাচ প্লেয়ার। যে কোন সিরিজ বা টুর্নামেন্টের গুরুত্বপূর্ণ নকআউট ম্যাচের জন্য নিজের সেরাটা জমিয়ে রাখতেন সবসময়। ছিলেন তাঁর প্রজন্মের সেরাদের একজন; যার জাদুর কাঠির ছোঁয়ায় বদলে গিয়েছিল একটি দেশের ক্রিকেট মানচিত্র। বলছিলাম শ্রীলঙ্কান ক্রিকেটের প্রথম সুপারস্টার, '৯৬ বিশ্বকাপের মহানায়ক, সর্বকালের অন্যতম সেরা ম্যাচ উইনার অরবিন্দ ডি সিলভার কথা।

৯৩ টেস্টে ৪২.৯৭ গড়ে ৬৩৬১ রান। আর ৩০৮ ওয়ানডেতে ৩৪.৯০ গড়ে ৯২৮৪ রান। সাথে যোগ করুন ১৩৫টি আন্তর্জাতিক উইকেট। পরিসংখ্যান দেখে হয়ত ভাবছেন এ আর এমন কী? কিন্তু ওই যে কথায় বলে না ‘পরিসংখ্যান একটি আস্ত গাধা’। পরিসংখ্যান যে সবসময় একজন খেলোয়াড়কে ঠিকমতো চেনাতে পারে না তা বোঝানোর জন্যই কথাটি বলা হয়। লঙ্কান ব্যাটিং মায়েস্ত্রো অরবিন্দ ডি সিলভার বেলায়ও কথাটি খাটে। শচীন, লারা, সাঙ্গা, ক্যালিসদের মত বড় বড় লিজেন্ডদের পাশে ডি সিলভার রেকর্ড হয়তো কিছুই না। কিন্তু আমরা যারা টিভির পর্দায় সরাসরি তাঁর খেলা দেখেছি তারা নিশ্চয়ই জানি যে ঠিক কতটা উঁচুমানের খেলোয়াড় ছিলেন তিনি।

অধিকাংশ ক্রিকেটবোদ্ধার মতে, ডি সিলভার মত জাত ম্যাচ উইনার শুধু শ্রীলঙ্কা কেন, বিশ্ব ক্রিকেটেই এসেছে হাতেগোনা। অথচ ডি সিলভার গ্রেটনেস, ব্যাটসম্যানশিপ কিংবা শ্রীলঙ্কান ক্রিকেটে তাঁর যে সুদূরপ্রসারী ইম্প্যাক্ট তা বোঝানোর সাধ্য পরিসংখ্যানের নেই। শুনেছি সাঙ্গা-মাহেলার মত গ্রেটরা আসার পরেও নাকি শ্রীলঙ্কার মানুষ বিশ্বাস করে অরবিন্দ ডি সিলভাই তাদের ইতিহাসে সেরা ব্যাটসম্যান!

অরবিন্দ ডি সিলভাকে মনে করা হয় ক্রিকেট ইতিহাসের সেরা এন্টারটেইনারদের একজন। বিশ্ব ক্রিকেটে অরবিন্দের মত স্টাইলিশ, এলিগ্যান্ট ও ন্যাচারাল স্ট্রোকপ্লেয়ার খুব কমই এসেছে। উইকেটের চারপাশ জুড়ে ছোটাতে পারতেন বাহারি সব স্ট্রোকের ফুলঝুরি; বিশেষ করে 'স্কয়ার অফ দ্য উইকেটে' হরাইজন্টাল শট খেলায় ছিলেন দারুণ পারদর্শী।

উচ্চতা মাত্র ৫ ফুট ৩ ইঞ্চি হলে কী হবে! নিখুঁত ব্যালান্সের সাথে তাঁর ছিল দুর্দান্ত হ্যান্ডআই কো-অর্ডিনেশন। কম্পালসিভ পুলার এবং হুকার ছিলেন; চোখের পলকে পড়ে ফেলতে পারতেন বলের লেন্থ। 'ড্রাইভিং অন দ্য আপ' এবং নান্দনিক পুল শট ছিল তাঁর ট্রেডমার্ক। এছাড়া ফ্লিক, গ্লান্স এবং সুইপ শটে তাঁর নমনীয় কব্জির রিস্টপ্লে ছিল দেখার মতো। প্যাডল সুইপের মত কঠিন শটেও তাঁর ছিল অবিশ্বাস্য দখল।

ব্রিটিশ ক্রীড়াসাংবাদিক সাইমন ওয়াইল্ডের ভাষায়, “Since he had always been well balanced off his toes while batting, he went about striking it with phenomenal grace and ease. Be it cover drives or square drives, De Silva was the best ever to play them on the up.”

টেকনিক্যালি সাউণ্ড, ওয়াইড রেঞ্জ অব স্ট্রোকস, সামর্থ্য ও ট্যালেন্ট নিয়ে কোন সন্দেহ নেই — অথচ ক্যারিয়ারের শুরুতে এই ডি সিলভাই ছিলেন চরম ইনকন্সিস্ট্যান্ট। কারণ ম্যাচ্যুরিটি এবং টেম্পারমেন্টের অভাব! অহেতুক ঝুঁকিপূর্ণ শট খেলে উইকেট থ্রো করে আসার প্রবণতার জন্য নামের পাশে জুড়ে দেয়া হয়েছিল ম্যাড ম্যাক্সের খেতাব! কিন্তু এই ম্যাড ম্যাক্সের মধ্যে একটা বিশেষ গুণ ছিল যা সবার মধ্যে থাকে না। আর তা হল একা হাতে ম্যাচ জেতানোর ক্ষমতা। ফলে ডি সিলভার ওপর থেকে কখনও বিশ্বাস হারান নি লঙ্কান নির্বাচকরা। ক্ষ্যাপাটে 'ম্যাড ম্যাক্স' থেকেই একদিন তিনি হয়ে ওঠেন দলের প্রধান ব্যাটিং ভরসা!

নিজের ব্যাটিংয়ের ধরন নিয়ে অবশ্য ডি সিলভার মধ্যে কোন প্রকার আক্ষেপ ছিল না। এক সাক্ষাৎকারে জানিয়েছিলেন, "That's my natural game – I don't want to change because I feel confident playing that way. If someone is capable of dominating the bowling, they should do it.”

চলুন এক নজরে দেখে নিই অরবিন্দ ডি সিলভার আন্তর্জাতিক ক্যারিয়ার হাইলাইটস।

★ ছোটবেলা থেকেই ডি সিলভাকে গণ্য করা হত স্পেশাল ট্যালেন্ট হিসেবে। স্টাইল আর এগ্রেসনের একটা নিখুঁত মেলবন্ধন ছিল তাঁর ব্যাটিংয়ে; যা সহজেই আকৃষ্ট করত। যার ফলাফল ১৯৮৪ সালে মাত্র ১৮ বছর বয়সে ওয়ানডে অভিষেক; ঘরোয়া লিস্ট 'এ' ক্রিকেটে অভিষেকের পূর্বেই!

নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে অভিষেক ম্যাচে অবশ্য বলার মত কিছুই করতে পারেননি। স্যার রিচার্ড হ্যাডলির ইনসুইঙ্গারে বোল্ড হবার আগে করেছিলেন মাত্র ৮ রান।

★ ওয়ানডে অভিষেকের চার মাস পরই টেস্ট অভিষেক, লর্ডসে ইংল্যান্ডের বিপক্ষে। সে অভিজ্ঞতাও ছিল ভুলে যাবার মতোই। দুই ইনিংস মিলে করেছিলেন মাত্র ১৯ রান।

★ ১৯৮৪ সালের নভেম্বরে দেশের মাটিতে নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে হাঁকান ক্যারিয়ারের প্রথম ওডিয়াই ফিফটি। লো স্কোরিং ম্যাচে ডি সিলভার খেলা ৫৪ বলে ৫০ রানের ছোট্ট কিন্তু অসাধারণ ইনিংসটিই শেষ পর্যন্ত ব্যবধান গড়ে দিয়েছিল। এছাড়া বল হাতেও ছিল দারুণ একটি ইকোনমিক্যাল স্পেল (৯-১-২৫-০)। যথারীতি ম্যাচসেরার পুরস্কারটাও উঠেছিল তাঁর হাতেই।

★ ১৯৮৫ সালের জানুয়ারিতে বেনসন এন্ড হেজেস ওয়ার্ল্ড সিরিজে অংশ নিতে অস্ট্রেলিয়া যান ডি সিলভা। সিডনিতে স্বাগতিকদের বিপক্ষে ম্যাচ। অজিদের দেয়া ২২৭ রানের লক্ষ্য তাড়া করতে নেমে ডি সিলভা খেলেন ৩৭ বলে ৪৬* রানের একটি চমৎকার ফিনিশিং নক।

সব ম্যাচে রান না পেলেও অস্ট্রেলিয়ার বিরুদ্ধে খেলেন ৮৭ বলে ৮১ রানের আরও একটি অনবদ্য ইনিংস। শেষ পর্যন্ত শ্রীলঙ্কা ম্যাচটা ৩ উইকেটে হেরে গেলেও ১৯ বছরের 'টিনএজার' ডি সিলভার সাহসী ইনিংসটা ক্রিকেটের বোদ্ধামহলে ব্যাপকভাবে প্রশংসিত হয়েছিল।

★ ১৯৮৫ সালের সেপ্টেম্বরে কলম্বোর পি সারা ওভালে ভারতের বিপক্ষে 'ঐতিহাসিক' টেস্ট জয়ে ব্যাট হাতে অবদান রেখেছিলেন ডি সিলভাও; খেলেছিলেন ৭৫ রানের গুরুত্বপূর্ণ একটি ইনিংস।

উল্লেখ্য, এটাই ছিল শ্রীলঙ্কার ইতিহাসে প্রথম টেস্ট জয়।

★ পরের মাসে পাকিস্তান সফরে এসে পেয়ে যান ক্যারিয়ারের প্রথম টেস্ট সেঞ্চুরি (১২২)। সেঞ্চুরিটা করতে গিয়ে অবশ্য অনেক কাঠখড় পোহাতে হয়েছিল তাঁকে; ক্রিজ আঁকড়ে পড়ে ছিলেন পাক্কা সাড়ে আট ঘন্টা! মজার ব্যাপার হল, সেঞ্চুরির মাইলফলকটা তিনি ছুঁয়েছিলেন ইমরান খানের বাউন্সারে হুক শটে ছক্কা মেরে!

এরপর করাচিতে সিরিজের তৃতীয় টেস্টে হাঁকান আরও একটি সেঞ্চুরি। এবার অবশ্য খেলেছিলেন হাত খুলে। ১৭টা বাউন্ডারির সাথে মেরেছিলেন ৩টা ছক্কাও। শ্রীলঙ্কার দলীয় সংগ্রহ ২৩০ রানের মধ্যে ডি সিলভার একারই ছিল ১০৫ রান। যেখানে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ ছিল ২৫ রান!

এই দুটো সেঞ্চুরি দিয়েই মূলত আন্তর্জাতিক মঞ্চে নিজের জায়গাটা পাকা করেছিলেন তিনি। পাকিস্তানের বর্ষীয়ান ক্রীড়ালেখক সেলিম পারভেজের ভাষায়, “To produce two technically correct hundreds of contrasting style, was the beginning of Aravinda’s journey to greatness.”

টেস্ট সিরিজ শেষে হয়েছিল চার ম্যাচের ওয়ানডে সিরিজ। ডি সিলভা রান পেয়েছিলেন মাত্র একটা ম্যাচে। ক্যারিয়ারে প্রথমবারের মত ওপেন করতে নেমে ৪ বাউন্ডারি ও ৪ ছক্কায় খেলেছিলেন ৯২ বলে ৮৬ রানের চোখ ধাঁধানো এক ইনিংস। মিডল অর্ডারের ব্যর্থতায় শেষ পর্যন্ত শ্রীলঙ্কা মাত্র ১৫ রানে ম্যাচটা হেরে গেলেও ম্যাচসেরা হয়েছিলেন ডি সিলভাই।

★ ১৯৮৬ থেকে ১৯৮৭ পর্যন্ত টানা দুই বছর কেটেছিল রানখরায়। ১৯৮৭ বিশ্বকাপে ৬ ম্যাচ খেলে করেছিলেন ২৫.২৫ গড়ে মাত্র ১০১ রান।

★ ১৯৮৮ সালে বছরের শুরুতেই তিনি আভাস দেন ফর্মে ফেরার। জানুয়ারিতে অস্ট্রেলিয়ায় আয়োজিত ওয়ার্ল্ড সিরিজে ৩ ফিফটিসহ ডি সিলভার ব্যাট থেকে আসে ২৭৯ রান।

★ একই বছর মার্চে শারজায় ভারতের বিপক্ষে উপহার দেন ১০০ বলে ৮৮ রানের দারুণ একটি 'ম্যাচ উইনিং' নক; ওয়ানডে ক্যারিয়ারে তৃতীয়বারের মত জিতে নেন ম্যাচসেরার পুরস্কার।

★ টানা তিনটি টেস্ট সিরিজে রান পান নি। অবশেষে ১৯৮৯ সালে অস্ট্রেলিয়া সফরে এসে পেলেন প্রায় ভুলতে বসা টেস্ট সেঞ্চুরির স্বাদ; চার বছর পর! ব্রিসবেনে সিরিজের দ্বিতীয় টেস্টে খেললেন ১৬৭ রানের একটি দুর্দান্ত 'ম্যাচ সেভিং' ইনিংস। আত্মবিশ্বাসে বলীয়ান হয়ে হোবার্টে পরের টেস্টে হাঁকালেন জোড়া ফিফটি (৭৫ ও ৭২)।

উল্লেখ্য, গ্যাবার বাউন্সি ট্র্যাকে ডি সিলভার ১৬৭ রানের ইনিংসটা ছিল অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে কোন শ্রীলঙ্কান ব্যাটসম্যানের প্রথম টেস্ট সেঞ্চুরি। ইনিংসটি নাকি এতটাই নিখুঁত ও ফ্ললেস ছিল যে আজও এটিকে বিদেশের মাটিতে খেলা শ্রীলঙ্কার সেরা ব্যক্তিগত ইনিংসের স্বীকৃতি দিয়ে থাকেন অনেকে।

★ ১৯৮৯ সালের অক্টোবরে অনুষ্ঠিত এমআরএফ ওয়ার্ল্ড সিরিজের পাঁচ ম্যাচে তিনবার পেলেন ফিফটির দেখা (৮০, ৯৬, ৮৩); দুটিতে হলেন ম্যাচসেরা।

★ ১৯৯০ সালে নাগপুরে ভারতের বিপক্ষে পেয়ে যান ক্যারিয়ারের প্রথম ওয়ানডে সেঞ্চুরি। শ্রীলঙ্কা ১৯ রানে ম্যাচটা হেরে যাওয়ায় সেঞ্চুরিটা শেষ পর্যন্ত বিফলে গিয়েছিল।

★ ১৯৯১ সালে ইতিহাসে প্রথমবারের মত নিউজিল্যান্ডের মাটিতে টেস্ট সিরিজ ড্র করতে সমর্থ হয় শ্রীলঙ্কা। তিন ম্যাচে ২ সেঞ্চুরি আর ১ ফিফটিতে ডি সিলভার ব্যাট থেকে এসেছিল ৪৯৩ রান!

উল্লেখ্য, সিরিজের প্রথম ম্যাচেই তিনি পেয়ে যান টেস্ট ক্যারিয়ারের প্রথম ডাবল সেঞ্চুরির দেখা। ওয়েলিংটনের বেসিন রিজার্ভে উপহার দেন ২৬৭ রানের এক অনবদ্য মাস্টারক্লাস। অকল্যান্ডে পরের টেস্টে করেন ১২৩ ও ৯৬ রান।

★ ১৯৯২ বিশ্বকাপে শ্রীলঙ্কার অধিনায়ক মনোনীত হন ডি সিলভা। কিন্তু তাঁর নেতৃত্বে ৮ ম্যাচের মাত্র ২টিতে জিতে গ্রুপ পর্ব থেকেই বিদায় নেয় শ্রীলঙ্কা। ব্যাট হাতে ডি সিলভাও ছিলেন ফ্লপ; ৮ ম্যাচ খেলে মাত্র ২৫ গড়ে করেছিলেন ১৭৫ রান।

এছাড়া ১৯৯১-১৯৯২ পর্যন্ত পাকিস্তান ও অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে দুটি সিরিজে মোট ৬টি টেস্টেও দলকে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন ডি সিলভা। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত দুটি সিরিজই লজ্জাজনকভাবে হেরেছিল শ্রীলঙ্কা। ফলাফল এক বছর যেতে না যেতেই অধিনায়কত্বের পাঠ চুকে যায় তাঁর।

★ বিশ্বকাপের হতাশা কাটিয়ে উঠতে অবশ্য খুব বেশিদিন সময় নেন নি তিনি। ১৯৯২ সালের আগস্টে দেশের মাটিতে অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে 'ঐতিহাসিক' ওয়ানডে সিরিজ জয়ে (২-১) নেতৃত্ব দেন সামনে থেকে। পরপর দুই ম্যাচে উপহার দেন ১০৫ বলে ১০৫* এবং ৬১ বলে ৬৩ রানের দুটি ম্যাচ উইনিং ইনিংস। ৩ ম্যাচে ২০৭ রান করে জিতে নেন সিরিজসেরার পুরস্কার।

★ ১৯৯৩ সালের মার্চে দেশের মাটিতে ইংল্যান্ডকেও ওয়ানডে সিরিজে (২-০) পরাজিত করে শ্রীলঙ্কা। সিরিজ নির্ধারণী শেষ ম্যাচে ডি সিলভার ব্যাট থেকে আসে ৬৮ বলে ৭৫* রানের আরও একটি ম্যাচ উইনিং নক। এছাড়া ৭ ওভার বল করে ২২ রানে নেন ১ উইকেট।

★ এর আগে বিদেশের মাটিতে সেঞ্চুরি করলেও দেশের মাটিতে কিছুতেই পাচ্ছিলেন না তিন অঙ্কের দেখা। অবশেষে ১৯৯৪ সালের আগস্টে 'হোমগ্রাউন্ড' কলম্বোতে দারুণ এক সেঞ্চুরি (১৪৮) তুলে নেন ভারতের বিপক্ষে।

একই মাসে পাকিস্তানের বিপক্ষে উপহার দেন ১৫৬ বলে ১২৭ রানের স্ট্রোক ঝলমলে এক ইনিংস; ১৯ চার ও ১ ছক্কার সাহায্যে। টু ডব্লুজের বিধ্বংসী বোলিংয়ে শ্রীলঙ্কা হেরেছিল ৩০১ রানের বিশাল ব্যবধানে।

★ ১৯৯৪ সালের নভেম্বরে ইতিহাসে প্রথমবারের মত জিম্বাবুয়ের মাটিতে ওয়ানডে সিরিজ (২-১) জেতে শ্রীলঙ্কা। তিন ম্যাচে এক সেঞ্চুরি ও এক ফিফটিসহ ২৩৯ রান করে সিরিজসেরা হয়েছিলেন অরবিন্দ ডি সিলভা। সিরিজ নির্ধারণী শেষ ম্যাচে খেলেছিলেন ১০০ বলে অপরাজিত ১০৭ রানের দুর্ধর্ষ এক ইনিংস।

★ ডিসেম্বরে দক্ষিণ আফ্রিকার মাটিতে স্বাগতিক দলসহ পাকিস্তান, নিউজিল্যান্ড ও শ্রীলঙ্কাকে নিয়ে হয়েছিল চার জাতি ম্যান্ডেলা ট্রফি। সেখানে টানা ৩ ম্যাচে ফিফটি হাঁকিয়েছিলেন ডি সিলভা।

পাকিস্তানের বিপক্ষে ৭ চার ও ৩ ছক্কায় ১০৫ বলে ৯৫ রানের দুর্দান্ত ইনিংস খেলেও শেষ পর্যন্ত হারতে হয়েছিল ১২ রানে। নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে বৃষ্টিতে পরিত্যক্ত পরের ম্যাচে করেছিলেন ৪৫ বলে ৫৫ রান। তারপর দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে শেষ ম্যাচে ৯৫ বলে ৮৩ রান করে হয়েছিলেন ম্যাচসেরা।

★ ১৯৯৫ সালের জুনে ইংলিশ কাউন্টির দল কেন্টের সাথে চুক্তিবদ্ধ হন ডি সিলভা। ঘরোয়া ওয়ানডে টুর্নামেন্ট বেনসন অ্যান্ড হেজেস কাপের ফাইনালে ল্যাঙ্কাশায়ারের বিপক্ষে খেলেন মাত্র ৯৫ বলে ১১২ রানের 'অনন্যসাধারণ' এক ইনিংস। ৩টি ছয় (৩টা ছক্কাই ছিল পুল শটে) ও ১১টি চারে সাজানো ইনিংসটিকে কাউন্টির 'লিস্ট এ' ইতিহাসে সেরা ইনিংসের স্বীকৃতি দিয়ে থাকেন অনেকে।

★ ১৯৯৫ সালের সেপ্টেম্বরে 'ঐতিহাসিক' ফয়সালাবাদ টেস্টে পাকিস্তানের বিপক্ষে ১১০ রানে পিছিয়ে থেকে নিজেদের দ্বিতীয় ইনিংস শুরু করে শ্রীলঙ্কা। অরবিন্দ ডি সিলভার অনবদ্য ১০৫ রানের ইনিংসে ভর করে পাকিস্তানকে ২৫২ রানের চ্যালেঞ্জিং টার্গেট ছুঁড়ে দেয় তারা। টার্গেট তাড়া করতে নেমে ভাস-মুরালি জুটির বোলিং তোপে পাকিস্তান শেষ পর্যন্ত অলআউট হয় ২০৯ রানে। ৪২ রানের অবিস্মরণীয় এক জয় তুলে নিয়ে সিরিজে ১-১ এ সমতা ফেরায় লঙ্কানরা।

উল্লেখ্য, এটি ছিল পাকিস্তানের মাটিতে শ্রীলঙ্কার ইতিহাসে প্রথম টেস্ট জয়। শুধু টেস্ট জিতেই অবশ্য ক্ষান্ত থাকে নি তারা; টানা দুই ম্যাচ জিতে গড়েছিল পাকিস্তানের মাটিতে প্রথম সিরিজ জয়ের কীর্তি।

টেস্টের পর ওয়ানডে সিরিজটাও ২-১ ব্যবধানে জিতে নেয় শ্রীলঙ্কা। মাত্র ১৭.৮০ গড়ে ৫ উইকেট নিয়ে সিরিজের সেরা বোলার ছিলেন অরবিন্দ ডি সিলভা। এছাড়া ব্যাট হাতে ১ ফিফটিসহ করেছিলেন ৯৫ রান।

★ পরের মাসেই শারজায় অনুষ্ঠিত হয় চারজাতি সিঙ্গার কাপ। পুরো টুর্নামেন্টে নিষ্প্রভ থাকলেও ডি সিলভা জ্বলে ওঠেন ফাইনালে। ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে ৪ চার ও ২ ছক্কায় খেলেন ৩৫ বলে ৫০ রানের একটি চমৎকার ম্যাচ উইনিং 'ক্যামিও'।

★ ১৯৯৬ বিশ্বকাপ শুরুর আগে অস্ট্রেলিয়ার মাটিতে একটা ত্রিদেশীয় সিরিজে অংশ নেয় শ্রীলঙ্কা। উইন্ডিজকে টপকে শ্রীলঙ্কার ফাইনালে ওঠাটাকে অবশ্য চমকই বলতে হবে। তবে সিরিজ জুড়ে নিষ্প্রভ ছিলেন ডি সিলভা। ১০ ম্যাচ খেলে মাত্র ২৫.৮ গড়ে করেছিলেন ২৫৮ রান।

★ ১৯৯৬ বিশ্বকাপটা ছিল ডি সিলভার ক্যারিয়ারের সবচাইতে উজ্জ্বলতম অধ্যায়। ৬ ম্যাচ খেলে ৪টিতেই হয়েছিলেন ম্যাচসেরা! ২ সেঞ্চুরি ও ২ ফিফটিতে ৮৯.৯০ গড়ে করেছিলেন ৪৪৮ রান! স্ট্রাইক রেট ছিল ১০৭.৬৯! পাশাপাশি বল হাতেও নিয়েছিলেন ৪ উইকেট।

সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য ব্যাপার, সেমিফাইনাল ও ফাইনালের মত হাই ভোল্টেজ ম্যাচের 'ম্যান অব দ্য ম্যাচ' ছিলেন তিনি।

গ্রুপ পর্বে অস্ট্রেলিয়া ও উইন্ডিজের বিপক্ষে ওয়াকওভার পাওয়া শ্রীলঙ্কা জিতেছিল জিম্বাবুয়ে, ভারত ও কেনিয়ার বিপক্ষে সবগুলো ম্যাচেই। জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে ৮৬ বলে ৯১ আর কেনিয়ার বিপক্ষে মাত্র ১১৫ বলে ১৪৫ রান করে যার দুটিতে ম্যাচসেরা হয়েছিলেন অরবিন্দ ডি সিলভা।

এরপর কোয়ার্টার ফাইনালে তারা ইংল্যান্ডকে হারায় জয়াসুরিয়া ম্যাজিকে (৪৪ বলে ৮২) ভর করে। ডি সিলভার ব্যাট থেকে আসে ৩০ বলে ৩১ রান। তারপর সেমিফাইনাল আর ফাইনাল ম্যাচ দুটো ছিল শুধুই ডি সিলভাময়!

ভারতের বিপক্ষে সেমিফাইনালটা হয়েছিল কলকাতার ইডেন গার্ডেনে। টসে জিতে ভারতীয় অধিনায়ক আজহারউদ্দীন নিয়েছিলেন ফিল্ডিংয়ের সিদ্ধান্ত। এদিকে লঙ্কান ইনিংসের শুরুতেই জাভাগাল শ্রীনাথের জোড়া আঘাত। মাত্র ১ রান তুলতেই নেই দুই ওপেনার সনাৎ জয়াসুরিয়া ও রুমেশ কালুভিতারানা। ক্রিজে আসলেন অরবিন্দ ডি সিলভা। নেমেই স্বভাবসুলভ ভঙ্গিতে শুরু করলেন প্রতি আক্রমণ। গায়ে জ্বর নিয়েই একে একে হাঁকালেন ১৪টা বাউন্ডারি! কুম্বলের ফ্লিপারে বোল্ড হয়ে ডি সিলভা যখন সাজঘরে ফিরছেন, দলীয় স্কোর তখন ১৪.২ ওভারে ৮৫ আর ডি সিলভার নামের পাশে লেখা ৪৭ বলে ৬৬!

ম্যাচ সিচুয়েশন আর ইমপ্যাক্ট বিবেচনায় নিলে ডি সিলভার '৬৬' নিঃসন্দেহে বিশ্বকাপ ইতিহাসের অন্যতম সেরা ইনিংস। শেষ পর্যন্ত ওই স্বল্পস্থায়ী কিন্তু জাদুকরী ইনিংসটাই যে গড়ে দিয়েছিল ম্যাচের ভাগ্য! শ্রীলঙ্কার দেয়া ২৫২ রানের টার্গেট টপকাতে গিয়ে রীতিমতো মুখ থুবড়ে পড়েছিল ভারতীয় ব্যাটিং লাইনআপ।

অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে ফাইনালের ভেন্যু ছিল লাহোরের গাদ্দাফি স্টেডিয়াম। এবারে টসে জিতে লংকান অধিনায়ক অর্জুনা রানাতুঙ্গাও নিলেন ফিল্ডিংয়ের সিদ্ধান্ত। এদিকে রিকি পন্টিং (৪৫) আর অধিনায়ক মার্ক টেলরের (৭৪) ব্যাটে চড়ে অস্ট্রেলিয়া যখন বড় সংগ্রহের স্বপ্ন দেখছে ঠিক তখনই আঘাত হানলেন অরবিন্দ ডি সিলভা। টুর্নামেন্টে প্রথমবারের মত জ্বলে উঠলেন বল হাতে! ডানহাতি অফ স্পিনে ফিরিয়ে দিলেন দুই অভিজ্ঞ সেট ব্যাটসম্যানকে। লঙ্কান স্পিনারদের নিয়ন্ত্রিত বোলিংয়ে শেষ পর্যন্ত অস্ট্রেলিয়ার সংগ্রহ দাঁড়ায় ৭ উইকেটে ২৪১ রান। ১০ ওভার বল করে ৪৬ রান খরচায় ডি সিলভার পকেটে ছিল ৩ উইকেট।

২৪২ রানের লক্ষ্য তাড়া করতে নেমে জয়া-কালুর উদ্বোধনী জুটি আবারও ব্যর্থ। মাত্র ২৩ রান তুলতেই দুই ওপেনারকে হারিয়ে লঙ্কান শিবিরে যখন কিছুটা অনিশ্চয়তা বিরাজ করছে, ঠিক তখনই আরও একবার ত্রাতার ভূমিকায় অবতীর্ণ হলেন অরবিন্দ ডি সিলভা। কোনরকম তাড়াহুড়ো না করে মাথা ঠান্ডা রেখে খেললেন ১২৪ বলে ১০৭ রানের এক অনবদ্য মাস্টারক্লাস। অশোঙ্কা গুরুসিনহা আর অধিনায়ক রানাতুঙ্গাকে নিয়ে গড়লেন দুটি ম্যাচ উইনিং পার্টনারশিপ। ১০৭ রানে অপরাজিত থেকে একেবারে জিতিয়েই মাঠ ছাড়লেন। এককথায় নিখুঁত, ফ্ললেস ইনিংস যাকে বলে!

উল্লেখ্য, উইজডেন মনোনীত ওয়ানডের টপ হান্ড্রেড ব্যাটিং পারফরম্যান্সের তালিকায় ডি সিলভার সেঞ্চুরিটি রয়েছে ৮ নম্বরে। শুধু তা-ই নয়, ডি সিলভার ৪৬ রানে ৩ উইকেটও জায়গা পেয়েছে উইজডেনের টপ হান্ড্রেড বোলিং পারফরম্যান্সের লিস্টে ৮২ নম্বরে।

১৯৯৬ বিশ্বকাপ জেতাটাকে মনে করা হয় শ্রীলঙ্কার ক্রিকেট ইতিহাসের সবচেয়ে বড় টার্নিং পয়েন্ট। নামের পাশ থেকে 'আন্ডারডগ' তকমাটা চিরতরে ঘুচিয়ে দিতে এর চেয়ে ভাল উপলক্ষ বোধ হয় আর হতে পারত না।

★ ১৯৯৬ সালের আগস্টে ভারত, অস্ট্রেলিয়া ও জিম্বাবুয়েকে নিয়ে শ্রীলঙ্কায় অনুষ্ঠিত হয় সিঙ্গার ওয়ার্ল্ড সিরিজ। উক্ত সিরিজে ফাইনালসহ টানা ৩ ম্যাচে ম্যাচসেরা হওয়ার গৌরব অর্জন করেন অরবিন্দ ডি সিলভা।

উল্লেখ্য, ফাইনালসহ সিরিজের চার ম্যাচের চারটিতেই অপরাজিত ছিলেন ডি সিলভা!

- ভারতের বিপক্ষে ৭৫ বলে ৪৯*
- অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে ৯৫ বলে ৮৩*
- জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে ১২৩ বলে ১২৭*
- ফাইনালে আবারও অজিদের বিপক্ষে ৬৪ বলে ৭৫*

★ ১৯৯৭ সালের এপ্রিলে পাকিস্তান, জিম্বাবুয়ে ও শ্রীলঙ্কাকে নিয়ে শারজায় অনুষ্ঠিত ত্রিদেশীয় সিরিজে ডি সিলভার ব্যাট থেকে আসে ১০২.৫০ গড়ে ৪১০ রান!

উল্লেখ্য, এবার দিয়ে দ্বিতীয়বারের মত ওয়ানডেতে টানা ৩ ম্যাচে  ম্যাচসেরা হওয়ার কৃতিত্ব অর্জন করেন তিনি। পাঁচ ম্যাচের ৪টিতেই ম্যাচসেরা হয়ে জিতে নেন সিরিজসেরার পুরষ্কারটাও।

- জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে ৮১ বলে ৬০ রান ও ১০-১-৩৪-১
- পাকিস্তানের বিপক্ষে ১১৭ বলে ৯৭ রান ও ৮-০-২৯-১
- পাকিস্তানের বিপক্ষে ১৩১ বলে ১৩৪ রান
- ফাইনালে পাকিস্তানের বিপক্ষে ১২৪ বলে ৮৭* রান এবং ৯-০-৩৫-২

ফাইনালের আগে পাকিস্তানের বিপক্ষে ডি সিলভার ১৩৪ রানের অনবদ্য ইনিংসটি সম্পর্কে উইজডেন লিখেছিল, “134 off 131 balls with 11 fours and 4 sixes, after walking in at 11/2. Easily one of his best ODI knock against Wasim and Waqar.”

★ একই মাসে পাকিস্তানের বিপক্ষে টেস্ট সিরিজে মাত্র ৮ দিনের ব্যবধানে টানা ৩ ইনিংসে সেঞ্চুরির কীর্তি গড়েন ডি সিলভা! কলম্বোর প্রেমাদাসা স্টেডিয়ামে ১৬৮ রানের 'ম্যাচ সেভিং' ইনিংস খেলার পর সিংহলিজ স্পোর্টস ক্লাব মাঠে হাঁকান জোড়া সেঞ্চুরি (১৩৮* ও ১০৫*)।

উল্লেখ্য, অরবিন্দ ডি সিলভাই টেস্ট ইতিহাসের একমাত্র ব্যাটসম্যান যিনি দুই ইনিংসেই হাঁকিয়েছেন অপরাজিত সেঞ্চুরি!

★ ১৯৯৭ সালের মে-জুনে ভারতে অনুষ্ঠিত তিনজাতি পেপসি ইন্ডিপেন্ডেন্স কাপে শ্রীলঙ্কাকে আরও একবার শিরোপা জিতিয়েছিলেন অরবিন্দ ডি সিলভা। পাকিস্তানের বিপক্ষে ফাইনালসহ পর পর দুই ম্যাচে হয়েছিলেন ম্যাচসেরা।

- মোহালিতে ৯০ বলে ৯০ রান এবং ১০-২-৩৯-২
- ফাইনালে কলকাতায় ৪৯ বলে ৫৭* রান ও ৫-০-২৬-১

★ আগস্টে ভারতের বিপক্ষে টেস্ট সিরিজে আরও একবার টানা ৩ ইনিংসে সেঞ্চুরির রেকর্ড গড়েন ডি সিলভা! প্রেমাদাসায় ১২৬ রানের পর এসএসসিতে আবারও তুলে নেন জোড়া সেঞ্চুরি (১৪৬ ও ১২০)।

একই মাসে অনুষ্ঠিত ওয়ানডে সিরিজে ভারতকে ৩-০ ব্যবধানে হোয়াইটওয়াশ করেছিল শ্রীলঙ্কা। প্রথম দুই ম্যাচে রান না পেলেও শেষ ম্যাচে ১১৭ বলে ১০৪ রান ও বল হাতে ২ উইকেট নিয়ে জয়ের নায়ক ছিলেন অরবিন্দ ডি সিলভা।

★ ডিসেম্বরে ভারত সফর এবং জানুয়ারিতে জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে হোম সিরিজে চাপের মুখে অসাধারণ দুটি ইনিংস খেলেছিলেন ডি সিলভা।

ভারতের বিপক্ষে চন্ডীগড় টেস্টে খেলেন ২৬৩ বলে অপরাজিত ১১০ রানের ম্যাচ সেভিং ইনিংস। ১০৭ রানে ৬ উইকেট হারিয়ে ধুঁকতে থাকা শ্রীলঙ্কাকে ফিরিয়ে আনেন নিশ্চিত পরাজয়ের মুখ থেকে।

জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে কলম্বো টেস্টে অবশ্য ম্যাচ বাঁচিয়ে নয়, ম্যাচ জিতিয়েই মাঠ ছেড়েছিলেন তিনি। চতুর্থ ইনিংসে জিম্বাবুয়ের দেয়া ৩২৬ রানের চ্যালেঞ্জিং লক্ষ্যে খেলতে নেমে এক পর্যায়ে শ্রীলঙ্কার স্কোর দাঁড়ায় ১৩৭/৫। সেখান থেকে ৩১২ বলে অপরাজিত ১৪৩ রানের অনবদ্য ইনিংস খেলে শ্রীলঙ্কাকে এনে দেন ৩ উইকেটের রূদ্ধশ্বাস এক জয়।

উল্লেখ্য, ১৯৯৭ সালটা নিঃসন্দেহে ছিল ডি সিলভার ক্যারিয়ারের সেরা বছর। টেস্ট এবং ওয়ানডে দুই ফরম্যাটেই পেরিয়েছিলেন সহস্রাধিক রানের কোটা।

ওয়ানডে- ৫২.৭০ গড়ে ১২১২ রান, সেঞ্চুরি ৩টা, ফিফটি ৮টা।
টেস্টে- ৭৬.২৫ গড়ে ১২২০ রান, সেঞ্চুরি ৭টা, ফিফটি ২টা।

★ ১৯৯৮ সালের জুনে অনুষ্ঠিত নিদাহাস ট্রফিতেও যথারীতি হেসেছিল অরবিন্দ ডি সিলভার ব্যাট। শ্রীলঙ্কাকে চ্যাম্পিয়ন করতে না পারলেও ১ সেঞ্চুরি আর ৩ ফিফটিসহ ডি সিলভার ব্যাট থেকে এসেছিল ৭৩.৬০ গড়ে ৩৬৮ রান; হয়েছিলেন ম্যান অব দ্য সিরিজ।

★ ১৯৯৮ সালের আগস্টে ইতিহাসে প্রথমবারের মত ইংল্যান্ডের মাটিতে টেস্ট জয়ের গৌরব অর্জন করে শ্রীলঙ্কা। লন্ডনের কেনিংটন ওভালে 'ঐতিহাসিক' সেই টেস্ট জয়ে সামনে থেকে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন মুত্তিয়া মুরালিধরন ও সনাৎ জয়াসুরিয়া। বল হাতে মুরালি একাই নিয়েছিলেন ১৬ উইকেট আর জয়াসুরিয়া হাঁকিয়েছিলেন ডাবল সেঞ্চুরি (২১৩)।

কিন্তু জয়া-মুরালিকে কৃতিত্ব দিতে গিয়ে 'পার্শ্বনায়ক' অরবিন্দ ডি সিলভার কথা ভুলে যান অনেকেই। ডি সিলভার অনবদ্য ১৫২ রানের ইনিংসটি না থাকলে হয়ত ম্যাচটা তারা নাও জিততে পারত।

★ ১৯৯৯ সালের ইংল্যান্ড বিশ্বকাপে ডিফেন্ডিং চ্যাম্পিয়ন হিসেবে খেলতে এসে গ্রুপ পর্ব থেকেই বিদায় নিতে হয় লঙ্কানদের। আর ব্যাট হাতে ডি সিলভাও ছিলেন চূড়ান্ত পর্যায়ের ফ্লপ। ৫ ম্যাচ খেলে মাত্র ১৪.৬০ গড়ে করেছিলেন ৭৩ রান।

★ ডি সিলভার ফর্ম হারানোর সূত্রপাত ১৯৯৯ বিশ্বকাপ থেকেই। টেস্টে কালেভদ্রে রান পেলেও ওয়ানডেতে ছিলেন একেবারেই ব্যর্থ।

২০০২ সালে আফ্রিকার দেশ মরক্কোয় অনুষ্ঠিত হয়েছিল ত্রিদেশীয় টুর্নামেন্ট মরক্কো কাপ। টানা বেশ কয়েকটি ওডিয়াই সিরিজে ব্যর্থ ডি সিলভার ব্যাট আবারও হেসেছিল এই মরক্কো কাপেই। উপহার দিয়েছিলেন পাকিস্তানের বিপক্ষে ৮৪ বলে ৭৩* এবং দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে ৭৫ বলে ৭৭* রানের দুটি ম্যাচ উইনিং ইনিংস।

★ ২০০২ সালের জুলাইয়ে টেস্ট ক্রিকেট থেকে অবসরের ঘোষণা দেন ডি সিলভা। কলম্বোয় বাংলাদেশের বিপক্ষে বিদায়ী টেস্টে খেলেন ২৮ চার ও ১ ছক্কার সাহায্যে ২৩৪ বলে ২০৬ রানের স্মরণীয় এক ইনিংস।

উল্লেখ্য, টেস্ট ক্যারিয়ারের শেষ বলে একটি উইকেটও তুলে নিয়েছিলেন তিনি; প্যাভিলিয়নে ফেরত পাঠিয়েছিলেন বাংলাদেশের ডানহাতি পেসার আলমগীর কবিরকে।

★ ২০০২ সালের আইসিসি চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফিতে ভারতের সাথে যুগ্মভাবে চ্যাম্পিয়ন হয়েছিল শ্রীলঙ্কা। ব্যাট হাতে খুব বেশি রান না পেলেও দুটি গুরুত্বপূর্ণ জয়ে অবদান রেখেছিলেন ডি সিলভা।

পাকিস্তানের বিপক্ষে রান তাড়া করতে নেমে অপরাজিত ৬৬ রানের 'ফিনিশিং নক' খেলার পর সেমিফাইনালে অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে ম্যাচসেরা হন বোলিং দিয়ে। টানা ১০ ওভারের এক স্পেলে মাত্র ১৬ রান দিয়ে তুলে নেন ১ উইকেট।

★ ২০০৩ বিশ্বকাপটা ছিল ডি সিলভার ক্যারিয়ারে শেষবারের মত কিছু করে দেখানোর সুযোগ। ব্যাট কিংবা বল হাতে দলকে কোন জয় এনে দিতে না পারলেও নিজের সর্বস্বটুকু দিয়েই লড়েছিলেন তিনি।

গ্রুপ পর্বের গুরুত্বপূর্ণ শেষ ম্যাচে স্বাগতিক দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে খেলেছিলেন ৭৮ বলে ৭৩ রানের লড়াকু এক ইনিংস। ম্যাচটা শেষ পর্যন্ত টাই হয়।

এরপর সুপার সিক্স পর্বে অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে ৯৪ বলে ৯২ রানের স্ট্রোক ঝলমলে ইনিংস খেলে ডি সিলভা বুঝিয়ে দেন 'ফর্ম ইজ টেম্পোরারি, বাট ক্লাস ইজ পার্মানেন্ট।' লংকানরা অবশ্য বড় ব্যবধানে হেরে গিয়েছিল ম্যাচটা।

পোর্ট এলিজাবেথে অনুষ্ঠিত সেমিফাইনালে আরও একবার লঙ্কানদের মুখোমুখি অস্ট্রেলিয়া। ডি সিলভার ১৯ বছরের বর্ণাঢ্য ক্যারিয়ারের শেষ আন্তর্জাতিক ম্যাচ। সে ম্যাচে বল হাতে জ্বলে উঠলেও (১০-০-৩৬-২) ব্যর্থ হন ব্যাট হাতে। ১৬ বলে দুই বাউন্ডারিতে মাত্র ১১ রান করে দুর্ভাগ্যজনক এক রান আউটের শিকার হন তিনি আর এরই সাথে ধূলিসাৎ হয়ে যায় শ্রীলঙ্কার দ্বিতীয়বার বিশ্বকাপ ফাইনালে ওঠার স্বপ্ন।

বিদায়বেলাটা রাঙিয়ে যেতে না পারলেও ক্যারিয়ার নিয়ে কোন আক্ষেপ থাকার কথা নয় ১৫ হাজারেরও বেশি রান আর ৩১টি আন্তর্জাতিক সেঞ্চুরির মালিক অরবিন্দ ডি সিলভার। ১৯৯৬ সালে বিশ্বকাপ, ২০০২ সালে চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফি আর ছোট-বড় অসংখ্য শিরোপা জেতার পাশাপাশি ব্যক্তিগত অর্জনও তো কম নয়। টেস্টে ১২ বার আর ওয়ানডেতে সর্বমোট ৩০ বার জিতেছেন ম্যাচসেরার পুরস্কার। একমাত্র খেলোয়াড় হিসেবে গড়েছেন বিশ্বকাপ ফাইনালে সেঞ্চুরি ও তিন উইকেট নেওয়ার কীর্তি। ১৯৯৬ সালে উইজডেন মনোনীত বর্ষসেরা ক্রিকেটারের পুরস্কার জিতেছেন একবার।

উল্লেখ্য, উইজডেন মনোনীত সর্বকালের সেরা ১০০টি ওয়ানডে ইনিংসের তালিকায় এক ডি সিলভারই রয়েছে ৬টি ইনিংস! তাঁর চেয়ে বেশি ইনিংস আছে শুধুমাত্র স্যার ভিভ রিচার্ডসের (৭টি)।

শেষ করব একটি ছোট্ট পরিসংখ্যান দিয়ে। আন্তর্জাতিক ক্যারিয়ারে ডি সিলভা সবচেয়ে বেশি ১১টি (টেস্টে ৮টি, ওডিয়াইতে ৩টি) সেঞ্চুরি হাঁকিয়েছেন পাকিস্তানের বিপক্ষে। ইমরান খান, ওয়াসিম আকরাম, ওয়াকার ইউনুস, আব্দুল কাদির, সাকলায়েন মুশতাকের মত টপ কোয়ালিটির বোলারদের সামলে এতগুলো সেঞ্চুরি করা মোটেই চাট্টিখানি কথা নয়।

সেলিম পারভেজের ভাষায়, “Ever since the 1985-86 series, Aravinda took a liking to Pakistan bowlers and often producing his best when needed most.”