ক্রিকেট লিজেন্ডস

ইয়ান বোথামঃ ইংলিশ ক্রিকেটের ধ্রুবতারা

ক্রিকফ্রেঞ্জি করেসপন্ডেন্ট

ক্রিকফ্রেঞ্জি করেসপন্ডেন্ট
প্রকাশের তারিখ: 00:07 সোমবার, 01 অক্টোবর, 2018

|| ফ্রাইডে স্পেশাল ||

অ্যাশেজ, ১৯৮১। সিরিজের প্রথম দুই টেস্ট শেষে ১-০ তে এগিয়ে অস্ট্রেলিয়া। এদিকে হেডিংলিতে শুরু হতে যাওয়া তৃতীয় টেস্টের আগে অধিনায়ক পরিবর্তনের সিদ্ধান্ত নেয় ইংল্যান্ড। 'অফফর্মে' থাকা অলরাউন্ডার ইয়ান বোথামকে সরিয়ে নতুন অধিনায়ক করা হয় মাইক ব্রিয়ারলিকে।

উল্লেখ্য, হেডিংলি টেস্টের আগে সবশেষ ১২ টেস্টে বোথামের ব্যাট থেকে এসেছিল ১৩.১৪ গড়ে মাত্র ২৭৬ রান! একটা ফিফটি পর্যন্ত ছিল না! এমনকি বল হাতে ৩৫ উইকেট নিলেও ইনিংসে ৫ উইকেট নেই একবারও!

সিরিজের প্রথম দুই টেস্টের ৪ ইনিংসে ২ বার আউট হয়েছিলেন শূন্য রানে!

হেডিংলিতে টসে জিতে প্রথম ব্যাট করে অস্ট্রেলিয়া করেছিল ৪০১ রান। আগের দুই ম্যাচে ৬ উইকেট পাওয়া বোথাম এবার এক ইনিংসেই নিলেন ৬ উইকেট! জবাব দিতে নেমে শুরুতেই ভয়াবহ ব্যাটিং বিপর্যয়ে পড়ে ইংল্যান্ড। ৭ নম্বরে নামা বোথামের 'লড়াকু' ফিফটি (৫৪ বলে ৫০) সত্ত্বেও তারা অলআউট হয় মাত্র ১৭৪ রানে। ডুবতে হয় ফলোঅনের লজ্জায়!

এদিকে দ্বিতীয় ইনিংসেও একই দুর্দশা স্বাগতিক ব্যাটিং লাইনআপের। ডেনিস লিলি-টেরি অ্যাল্ডারম্যান জুটির বোলিং তোপে ১৩৫ রান তুলতেই নেই ৭ উইকেট! অথচ ইনিংস পরাজয় এড়াতে তখনও প্রয়োজন ৯৩ রান, হাতে আছে মাত্র ৩ উইকেট! স্বীকৃত ব্যাটসম্যান বলতে ক্রিজে আছেন শুধুমাত্র ইয়ান বোথাম।

এরপর বোথাম যা করলেন তা রূপকথার গল্পকেও হার মানায়! ২৭ চার ও ১ ছক্কায় মাত্র ১৪৮ বলে খেললেন ১৪৯ রানের 'অতিমানবীয়' এক ইনিংস! ফলে ইনিংস পরাজয়ের শঙ্কা তো দূর হলই, উল্টো অস্ট্রেলিয়াকেই চতুর্থ ইনিংসে ১৩০ রানের 'চ্যালেঞ্জ' ছুঁড়ে দিল ইংল্যান্ড। সেই চ্যালেঞ্জ উতরাতে গিয়ে অস্ট্রেলিয়া করে বসল ডাহা ফেল! ডানহাতি পেসার বব উইলিসের বিধ্বংসী বোলিংয়ে (৮/৪৩) মাত্র ১১১ রানেই গুটিয়ে গেল তারা।

মাত্র ১৮ রানের অবিশ্বাস্য এক জয়ে সিরিজে ১-১ সমতা ফিরিয়ে আনল ইংলিশরা। ১৯৯ রান আর ৭ উইকেট নিয়ে ম্যাচসেরা যথারীতি ইয়ান বোথাম।

সিরিজের চতুর্থ টেস্টটা হয়েছিল এজবাস্টনে। দুই ইনিংসে ব্যাট হাতে বোথাম করলেন মাত্র ২৬ ও ৩ রান। তবে পারফরম্যান্সের ঘাটতিটা তিনি পুষিয়ে দিলেন বল হাতে।

চতুর্থ ইনিংসে ১৫১ রানের 'মামুলি' লক্ষ্যে খেলতে নেমে একসময় অস্ট্রেলিয়ার স্কোর ছিল ১১৪/৫। আর ঠিক তখনি বল হাতে রুদ্রমূর্তি ধারণ করলেন বোথাম। ২৮ বলের 'অলৌকিক' এক স্পেলে ইনিংসের শেষ ৫টি উইকেট তুলে নিলেন মাত্র ১ রান খরচায়! বোথাম ম্যাজিকে ভর করে সিরিজে ২-১ ব্যবধানে এগিয়ে গেল ইংল্যান্ড।

উইজডেনের ভাষায়, “It should have been 3-0 in favour of Australia. Instead, they found themselves trailing 1-2, twice on the receiving end of that incredible 'freak of nature' called Ian Botham.”

ম্যানচেস্টারের ওল্ড ট্রাফোর্ডে সিরিজের পঞ্চম টেস্টে বোথাম খেললেন ১০২ বলে ১১৮ রানের 'বিস্ফোরক' এক ইনিংস; ১৩ চার আর ৬ ছক্কায়! আর বল হাতে দুই ইনিংস মিলে নিলেন ৫ উইকেট। বোথামের অলরাউন্ড নৈপুণ্যে ইংল্যান্ড জিতল ১০৩ রানে, সিরিজে এগিয়ে গেল ৩-১ ব্যবধানে।

বোথামের ১১৮ রানের 'দাপুটে' ইনিংসটি সম্পর্কে উইজডেন লিখেছিল, “Packed full of marvellous strokes. There was nothing fluky on show in his Manchester demolition act.”

হেডিংলি, এজবাস্টন এবং ওল্ড ট্রাফোর্ডে টানা তিন জয়ের তিনটিতেই ম্যাচসেরা ইয়ান 'সুপারম্যান' বোথাম!

ওভালে সিরিজের শেষ ম্যাচটা শেষ হয়েছিল অমীমাংসিতভাবে। বল হাতে বোথাম একাই নিয়েছিলেন ১০ উইকেট। তবে ম্যাচসেরা হয়েছিলেন ১১ উইকেট নেয়া ডেনিস লিলি।

৩৪ উইকেট আর ৩৯৯ রান নিয়ে ১৯৮১ অ্যাশেজ জয়ের মূল নায়ক ছিলেন ইয়ান বোথাম। যার ফলশ্রুতিতে পরবর্তীকালে এই সিরিজের নামই হয়ে যায় ‘বোথামের অ্যাশেজ’!

আশির দশকে একই সঙ্গে চারজন কিংবদন্তি অলরাউন্ডারের উত্থান দেখেছিল ক্রিকেট বিশ্ব। স্যার ইয়ান বোথাম ছিলেন তাঁদেরই একজন। ইমরান-বোথাম-কপিল-হ্যাডলি এই চারজনকে একসাথে ডাকা হত 'ফ্যাবুলাস ফোর' নামে।

টেস্ট ইতিহাসে এযাবৎ পর্যন্ত মাত্র তিনজন অলরাউন্ডারের আছে একই ম্যাচে সেঞ্চুরি ও ১০ উইকেট লাভের কৃতিত্ব! তাদের মাঝে সর্বপ্রথম হলেন বোথাম! বাকি দুজন হলেন ইমরান খান এবং সাকিব আল হাসান।

টেস্টে সবচেয়ে বেশি পাঁচবার একই ম্যাচে সেঞ্চুরি এবং ইনিংসে ৫ উইকেট নেয়ার কীর্তিটাও বোথামের দখলে। জেনে নিশ্চয়ই অবাক হবেন যে, টেস্ট ইতিহাসে এই কীর্তি দু'বারের বেশি কারোই নেই!

টেস্ট ইতিহাসে সর্বোচ্চ তিনবার এক সিরিজে ২৫০ রান এবং ২০ উইকেটের 'ডাবল' অর্জনের কৃতিত্ব দেখিয়েছেন মাত্র দুজন ক্রিকেটার। একজন হলেন স্যার গ্যারি সোবার্স আর অন্যজন স্যার ইয়ান বোথাম!

ভারতের কিংবদন্তি অলরাউন্ডার কপিল দেবের পর 'দ্বিতীয়' ব্যক্তি হলেন ইয়ান বোথাম যার রয়েছে টেস্টে ৫০০০ রান এবং ৩০০ উইকেটের 'ডাবল'।

চলুন এক নজরে দেখে নিই স্যার ইয়ান বোথামের আন্তর্জাতিক ক্যারিয়ার হাইলাইটস।

★ পুরো নাম ইয়ান টেরেন্স বোথাম। ডাকনাম বিফি। জন্ম ২৪ নভেম্বর ১৯৫৫, যুক্তরাজ্যের চেশায়ারে। বাবা হার্বার্ট লেসলি বোথাম কাজ করতেন ওয়েস্টল্যান্ড এয়ারক্রাফটে। আর মা ভায়োলেট ম্যারি ছিলেন পেশায় একজন নার্স। মজার ব্যাপার হল, বোথামের মা-বাবা দুজনেই আধা-পেশাদার লেভেলে ক্রিকেট খেলেছেন। সুতরাং বলা যায়, ক্রিকেট খেলাটা বিফির রক্তেই ছিল।

★ ছেলেবেলায় ক্রিকেটের পাশাপাশি ফুটবলটাও দারুণ খেলতেন বোথাম। স্কুলে থাকতে ক্রিকেট ফুটবল দুই খেলাতেই ছিলেন রীতিমতো 'অলরাউন্ডার'! মাত্র ১৩ বছর বয়সে ডাক পান সমারসেট অনূর্ধ্ব-১৫ যুব ক্রিকেট দলে। জুনিয়র কাউন্টির অভিষেক ইনিংসেই করেন ৮০ রান। কিছুদিন পর ক্রিস্টাল প্যালেস ক্লাব থেকে প্রস্তাব পান প্রথম বিভাগ ফুটবলে খেলার। তবে বিফির বাবা চেয়েছিলেন ছেলে ক্রিকেটেই ক্যারিয়ার গড়ুক।

★ বিফির ফার্স্ট ক্লাস অভিষেক ১৯৭৪ সালে সমারসেটের হয়ে মাত্র ১৮ বছর বয়সে। প্রতিপক্ষ ছিল ক্লাইভ লয়েডের ল্যাঙ্কাশায়ার।

★ ১৯৭৪ সালের ১২ জুন, হ্যাম্পশায়ারের দেয়া ১৮৩ রানের টার্গেট তাড়া করতে নেমে ১১৩ রানেই ৮ উইকেট হারিয়ে বসে সমারসেট। সেখান থেকে দলকে ১ উইকেটের শ্বাসরুদ্ধকর এক জয় এনে দেন 'টিনএজার' বিফি; খেলেন অপরাজিত ৫৪ রানের দুর্দান্ত একটি ইনিংস।

উল্লেখ্য, সেদিন ব্যাটিংয়ের সময় কিংবদন্তি ফাস্ট বোলার অ্যান্ডি রবার্টসের বাউন্সারে আঘাত পেয়ে ঘটনাস্থলেই চারটি দাঁত হারিয়েছিলেন বোথাম! মুখ এবং ঠোঁট কেটে প্রচুর রক্তক্ষরণ হয়েছিল কিন্তু তবুও মাঠ ছাড়েননি! পরে রবার্টসকে দুটো ছক্কাও মেরেছিলেন! সাহসিকতার চূড়ান্ত নমুনা আর কাকে বলে!

★ ইংল্যান্ডের হয়ে একদিনের আন্তর্জাতিক ম্যাচে বোথামের অভিষেক ১৯৭৬ সালে, ভিভ রিচার্ডসের ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে।

★ ১৯৭৭ সালে টেস্ট অভিষেক, অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে ট্রেন্টব্রিজে। অভিষেকেই ৫ উইকেট নিয়ে দলকে জেতাতে রেখেছিলেন বড় ভূমিকা। হেডিংলিতে পরের টেস্টেও শিকার করেন ৫ উইকেট।

সেবারের অ্যাশেজ সিরিজটা ইংল্যান্ড জিতেছিল ৩-০ ব্যবধানে। মাত্র দুটি ম্যাচ খেললেও অভিষেক সিরিজেই বোথাম পেয়ে যান প্রথম অ্যাশেজ জয়ের স্বাদ। 

★ ১৯৭৮ সালের ফেব্রুয়ারিতে রিচার্ড হ্যাডলির নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে দুর্দান্ত অলরাউন্ড নৈপুণ্য প্রদর্শন করেন ইয়ান বোথাম। বল হাতে ইনিংসে দুবার ৫ উইকেটসহ মাত্র ১৮.২৯ গড়ে নেন ১৭ উইকেট। এছাড়া ব্যাট হাতে তাঁর সংগ্রহ ছিল ৫৩.০ গড়ে ২১২ রান।

টেস্ট ক্যারিয়ারে প্রথম শতরানের দেখা পান ক্রাইস্টচার্চে। ব্যাট হাতে ১৩৩ রান (১০৩ ও ৩০*) করার পর বল হাতে নেন ৮ উইকেট (৫/৭৩ ও ৩/৩৮); ক্যারিয়ারের প্রথম বিদেশ সফরেই দলকে এনে দেন অবিস্মরণীয় এক জয়।

★ একই বছর জুনে পাকিস্তানের বিপক্ষে হোম সিরিজে পরপর দুই টেস্টে সেঞ্চুরি তুলে নেন বোথাম। ৭০.৬৭ গড়ে তাঁর ব্যাট থেকে আসে ২১২ রান আর বল হাতে মাত্র ১৬.০৮ গড়ে শিকার করেন ১৩ উইকেট।

বিফির ক্যারিয়ার সেরা বোলিংটাও এসেছিল ওই সিরিজেই। ঐতিহাসিক লর্ডস টেস্টে বোথামের দুর্দান্ত সেঞ্চুরি (১০৮) এবং ৩৪ রানে ৮ উইকেটের বিধ্বংসী স্পেলের সুবাদে ইংল্যান্ড জিতেছিল এক ইনিংস ও ১২০ রানের বিশাল ব্যবধানে।

★ আগস্টে ফিরতি সিরিজে নিউজিল্যান্ডকে ৩-০ ব্যবধানে হোয়াইটওয়াশ করে ইংল্যান্ড। ৩ বার ইনিংসে ৫ উইকেট এবং ১ বার ম্যাচে ১০ উইকেটসহ মাত্র ১৪.০৪ গড়ে ২৪ উইকেট নিয়ে সিরিজের সর্বোচ্চ উইকেটশিকারি ছিলেন বিফি।

★ ১৯৭৮-৭৯ সালে অস্ট্রেলিয়ার মাটিতে অ্যাশেজ জয়েও (৫-১) গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছিলেন বোথাম। ব্যাট হাতে ২৯১ রান করার পাশাপাশি বল হাতে নিয়েছিলেন ২৩ উইকেট।

★ ১৯৭৯ সালে ভারতের বিপক্ষে হাঁকান ক্যারিয়ারের চতুর্থ টেস্ট সেঞ্চুরি। হেডিংলি টেস্টে ১০ চার ও ৫ ছক্কায় খেলেন ১৩২ বলে ১৩৭ রানের বিস্ফোরক এক ইনিংস।

উইজডেনের ভাষায়, “one of the finest Test innings in the last twenty years.”

ইংল্যান্ড সেবার সিরিজ জিতেছিল ২-০ ব্যবধানে। দু'বার ইনিংসে ৫ উইকেটসহ মাত্র ২৩ গড়ে বোথাম নিয়েছিলেন ২০ উইকেট।

উল্লেখ্য, ওই সিরিজেই টেস্ট ইতিহাসের দ্রুততম খেলোয়াড় হিসেবে ১০০০ রান এবং ১০০ উইকেটের অলরাউন্ডার'স ডাবল অর্জন করেন বিফি। মাইলফলকটি ছুঁতে বিফির লেগেছিল মাত্র ২১ টেস্ট! যে রেকর্ডটি আজো কেউ ভাঙতে পারে নি। 

★ ১৯৭৯-৮০ সালের অ্যাশেজে অস্ট্রেলিয়ার মাটিতে ৩-০ ব্যবধানে হোয়াইটওয়াশ হয় সফরকারী ইংল্যান্ড। সতীর্থদের ব্যর্থতার মিছিলে একমাত্র ব্যতিক্রম ছিলেন বোথাম। ব্যাট হাতে ১ সেঞ্চুরিসহ ১৮৭ রান করার পাশাপাশি বল হাতে মাত্র ১৮.৫৩ গড়ে নেন ১৯ উইকেট; দু'বার ইনিংসে ৫ উইকেট এবং ১ বার ম্যাচে ১০ উইকেটসহ।

★ ১৯৮০ সালের ফেব্রুয়ারিতে ভারতীয় টেস্ট ক্রিকেটের সুবর্ণজয়ন্তী উপলক্ষে মুম্বাইয়ের ওয়াংখেড়ে স্টেডিয়ামে আয়োজন করা হয় এক ঐতিহাসিক টেস্ট ম্যাচের। উক্ত খেলায় ইতিহাসের প্রথম খেলোয়াড় হিসেবে একই টেস্টে সেঞ্চুরি ও ১০ উইকেট লাভের বিরল কৃতিত্ব অর্জন করেন স্যার ইয়ান বোথাম। 'ম্যাচসেরা' বিফির ১১৪ রান ও ১৩ উইকেটের (৬/৫৮ ও ৭/৪৮) সৌজন্যে স্বাগতিক ভারতের বিরুদ্ধে ১০ উইকেটের এক অনায়াস জয় তুলে নেয় সফরকারীরা।

★ ১৯৮১ সালের অ্যাশেজকে বলা হয় ‘বোথামের অ্যাশেজ’। ব্যাট হাতে ৩৯৯ রান করার পাশাপাশি বল হাতে ৩ বার ইনিংসে ৫ উইকেট ও ১ বার ম্যাচে ১০ উইকেটসহ মাত্র ২০.৫৯ গড়ে বোথাম নেন ৩৪ উইকেট!

★ ১৯৮১-৮২ সালের ভারত সফরে ব্যাট হাতে দুর্দান্ত পারফর্ম করেন বোথাম। ১ সেঞ্চুরি ও ৪ ফিফটিতে করেন ৪৪০ রান! এছাড়া বল হাতে তাঁর শিকার ছিল ১৭ উইকেট।

★ ১৯৮২ সালের ফেব্রুয়ারিতে ওয়ানডে ক্যারিয়ারে প্রথমবারের মত ম্যাচসেরা হবার গৌরব অর্জন করেন বোথাম। বিফির অলরাউন্ড নৈপুণ্যে (৫১ বলে ৬০* রান এবং ৪৫ রানে ২ উইকেট) শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে মাত্র ৫ রানের শ্বাসরুদ্ধকর এক জয় তুলে নেয় ইংল্যান্ড।

★ একই বছর জুন-জুলাইতে ভারতের বিপক্ষে আয়োজিত হোম সিরিজে তিনি পেয়ে যান ক্যারিয়ারের প্রথম ডাবল সেঞ্চুরি (২০৮)। তিন ম্যাচের সিরিজে বিফির ব্যাট থেকে এসেছিল ১৩৪.৩৩ গড়ে ৪০৩ রান। এছাড়া বল হাতে ১০টি উইকেটও লাভ করেন তিনি।

★ ১৯৮২ সালের জুলাইতে ইমরান খানের পাকিস্তানের বিপক্ষে ২-১ ব্যবধানে টেস্ট সিরিজ জেতে ইংল্যান্ড। ব্যাট হাতে ২১৬ রান আর বল হাতে ১৮ উইকেট নিয়ে যার নেপথ্য কারিগর ছিলেন স্যার ইয়ান বোথাম।

★ ১৯৮৩-৮৪ সালে ওয়েলিংটনের বেসিন রিজার্ভে স্বাগতিক নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে ১৩৮ রানের অসাধারণ এক ইনিংস খেলার পাশাপাশি বল হাতে ৬ উইকেট নিয়ে ম্যাচসেরা হয়েছিলেন স্যার ইয়ান বোথাম।

★ ১৯৮৪ সালের বিখ্যাত 'ব্ল্যাকওয়াশ' সিরিজে ওয়েস্ট ইন্ডিজের কাছে ৫-০ ব্যবধানে পরাজিত হয় 'স্বাগতিক' ইংল্যান্ড। উক্ত সিরিজে ইংলিশদের পক্ষে বলার মত কিছু করে দেখাতে পেরেছিলেন এক বোথামই। দু'বার ইনিংসে ৫ উইকেটসহ নিয়েছিলেন ১৯ উইকেট আর ৩ ফিফটিতে বোথামের ব্যাট থেকে এসেছিল ৩৪৭ রান।

উল্লেখ্য, 'ঐতিহাসিক' লর্ডস টেস্টে ব্যাট হাতে ১১১ রান এবং বল হাতে এক ইনিংসে ৮ উইকেট (৮/১০৩) নিয়েও দলকে পরাজয়ের হাত থেকে বাঁচাতে পারেন নি বিফি!

★ ১৯৮৫ সালের অ্যাশেজটা ৩-১ ব্যবধানে জিতে নেয় স্বাগতিক ইংল্যান্ড। যে জয়ে বল হাতে সামনে থেকে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন বোথাম। ২৫.৫৮ গড়ে ৩১ উইকেট নিয়ে হয়েছিলেন সিরিজের সর্বোচ্চ উইকেটশিকারি। এছাড়া তিনি ব্যাট হাতে করেছিলেন ৩ ফিফটিসহ ২৫৬ রান।

অ্যাশেজ জিতলেও ওয়ানডে সিরিজটা ২-১ ব্যবধানে হেরে যায় ইংল্যান্ড। অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে সিরিজের প্রথম ওয়ানডেতে অবশ্য জিতেছিল ইংলিশরাই। ব্যাট হাতে ৮২ বলে ৭৩ রান এবং বল হাতে ২ উইকেট নিয়ে ম্যাচসেরা হয়েছিলেন বিফি।

★ ১৯৮৬-৮৭ সালে অস্ট্রেলিয়ায় অনুষ্ঠিত ফিরতি অ্যাশেজের ট্রফিটাও (২-১) উঠেছিল ইংলিশদের হাতেই। ব্রিসবেনে সিরিজের প্রথম ম্যাচে বোথাম খেলেছিলেন ১৫৭ বলে ১৩৮ রানের দুর্দান্ত এক ইনিংস; জিতেছিলেন ম্যাচসেরার পুরস্কার।

উল্লেখ্য, ইংলিশ ক্রিকেটারদের মধ্যে একমাত্র বোথামেরই রয়েছে সর্বাধিক ৫টি অ্যাশেজ জয়ের কীর্তি।

★ ক্যারিয়ারের শেষভাগে এসে টেস্ট দলে অনিয়মিত হয়ে পড়েন বোথাম। ব্যাটে-বলে সেই চিরচেনা ফর্মটাও হারিয়ে ফেলেন। এ সময়টা মূলত ওয়ানডে খেলেই কাটিয়েছেন তিনি।

১৯৮৭ থেকে ১৯৯২ — এই ৫ বছরে মাত্র ১৪টি টেস্ট খেলে বোথামের সংগ্রহ ছিল ৩৯১ রান; ২০.৫৭ গড়ে! ফিফটি মাত্র ১টি!

আর বল হাতে পারফরম্যান্স ছিল আরও সাদামাটা। ১৪ টেস্টে উইকেট পেয়েছিলেন মাত্র ১৭টা! বোলিং গড় ৫৭.৫৩! ইনিংসে ৫ উইকেট নেই একবারও!

★ ১৯৮৭ সালের জানুয়ারিতে অনুষ্ঠিত চারজাতি ওয়ানডে সিরিজ 'বেনসন এন্ড হেজেস' কাপে অস্ট্রেলিয়ার বিরুদ্ধে খেলেন ৩৯ বলে ৬৮ রানের (৭ চার, ৩ ছক্কা) একটি 'ম্যাচ উইনিং' ইনিংস।

এরপর মেলবোর্নে অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে আরও একটি 'ম্যাচ উইনিং নক' উপহার দেন বিফি। পিঞ্চ হিটিং ওপেনারের ভূমিকায় খেলতে নেমে করেন ৫১ বলে ৭২ রান (১১ চার, ১ ছক্কা)।

★ ১৯৭৯, ১৯৮৩ এবং ১৯৯২ — ক্যারিয়ারে মোট তিনটি বিশ্বকাপ খেলেছেন বোথাম। দুবার ফাইনাল খেললেও শিরোপা জিততে পারেন নি একবারও। তাঁর বিশ্বকাপ রেকর্ড ততটা সমৃদ্ধ না হলেও ১৯৯২ বিশ্বকাপে গুরুত্বপূর্ণ দুটি ম্যাচ জিতিয়েছেন তিনি।

পার্থে ভারতের বিপক্ষে পাওয়া কষ্টার্জিত জয়ে (মাত্র ৯ রানে) বল হাতে বড় ভূমিকা রেখেছিলেন বোথাম। টানা ১০ ওভারের এক স্পেলে মাত্র ২৭ রান খরচায় নিয়েছিলেন শচীন টেন্ডুলকার ও বিনোদ কাম্বলির উইকেট।

এরপর সিডনিতে অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে ৮ উইকেটের জয় পাওয়া ম্যাচেও দুদলের মাঝে ব্যবধান গড়ে দিয়েছিল বিফির অনবদ্য অলরাউন্ড নৈপুণ্য। বল হাতে ক্যারিয়ার সেরা ৩১ রানে ৪ উইকেট শিকারের পর ইনিংস উদ্বোধন করতে নেমে তিনি খেলেছিলেন ৭৭ বলে ৫৩ রানের দায়িত্বশীল একটি ইনিংস।

★ ১৯৯২ সালের ফেব্রুয়ারিতে নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে একটি ওয়ানডেতে ওপেন করতে নেমে খেলেন ৭৩ বলে ৭৯ রানের আরও একটি ম্যাচ জেতানো ইনিংস। পরে বল হাতেও নেন ১ উইকেট; জিতে নেন ম্যাচসেরার পুরস্কার।

★ ১৯৯২ সালে পাকিস্তানের বিপক্ষে দেশের মাটিতে খেলেন ক্যারিয়ারের শেষ টেস্ট এবং ওয়ানডে সিরিজ।

লর্ডসে ক্যারিয়ারের শেষ টেস্টে বল হাতে ছিলেন উইকেটশূন্য। আর ব্যাট হাতে করেছিলেন মাত্র ২ ও ৬ রান; পাকিস্তানি ফাস্ট বোলার ওয়াকার ইউনুসের ভয়ানক গতি ও মুভমেন্টের সামনে পরাস্ত হয়েছিলেন দুবারই।

ওল্ড ট্র্যাফোর্ডে ক্যারিয়ারের শেষ একদিনের আন্তর্জাতিক ম্যাচেও উইকেটশূন্য ছিলেন তিনি আর ইংল্যান্ড ৬ উইকেটে জিতে যাওয়ায় ব্যাটিংয়ে নামার সুযোগই হয় নি।

চলুন এক নজরে দেখে নিই স্যার ইয়ান বোথামের আন্তর্জাতিক ক্যারিয়ার পরিসংখ্যান।

#টেস্টঃ

১০২ টেস্টে ৩৩.৫৪ গড়ে করেছেন ৫২০০ রান। ১৪টি সেঞ্চুরির সঙ্গে হাফ সেঞ্চুরি আছে ২২টি। ক্যারিয়ার সেরা ২০৮ রান, ভারতের বিপক্ষে।

এছাড়া বল হাতে ২৮.৪০ গড়ে উইকেট নিয়েছেন ৩৮৩টি। ইনিংসে ৫ উইকেট নিয়েছেন ২৭ বার, ম্যাচে ১০ উইকেট ৪ বার। সেরা বোলিং ৩৪ রানে ৮ উইকেট, বিপক্ষ পাকিস্তান।

#ওয়ানডেঃ

১১৬ ম্যাচে ২৩.২১ গড়ে বোথামের সংগ্রহ ২১১৩ রান। স্ট্রাইক রেট ৭৯.২৬। অর্ধশতক হাঁকিয়েছেন ৯টি। সর্বোচ্চ ৭৯ রান, নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে।

এছাড়া বল হাতে ২৮.৫৪ গড়ে তাঁর উইকেটসংখ্যা ১৪৫টি। ইনিংসে ৪ উইকেট নিয়েছেন ৩ বার। ক্যারিয়ার সেরা বোলিং ৩১ রানে ৪ উইকেট, বিপক্ষ অস্ট্রেলিয়া।

ক্যারিয়ারের প্রথমভাগে বোথাম ছিলেন একজন জেনুইন উইকেট টেকার; একজন কমপ্লিট ফাস্ট বোলার। নিখুঁত আউটসুইঙ্গার, ফাস্ট ইনসুইঙ্গিং ইয়র্কার, বাউন্সার, চেঞ্জ অব পেস — কী ছিল না তাঁর বোলিংয়ে!

উল্লেখ্য, বোথামের ক্যারিয়ারের প্রথম ২০২টি টেস্ট উইকেটের বোলিং গড় মাত্র ২১.২০! অথচ শেষ ১৮১ উইকেটের জন্য তাঁকে গুনতে হয়েছে উইকেটপ্রতি ৩৬.৪৩ রান!

অবিশ্বাস্য এই ছন্দপতনের আসল কারণ হচ্ছে ইনজুরি। ১৯৮২ সালের পর থেকে বেশ কয়েকবার কাঁধ এবং পিঠের ইনজুরিতে ভুগতে হয়েছে তাঁকে। ফলে সময়ের সাথে বলের গতি এবং সুইং করানোর ক্ষমতা — দুটোই হারিয়ে ফেলতে থাকেন বিফি। 

স্পেশালিষ্ট ব্যাটসম্যান না হয়েও বোথাম ছিলেন টেকনিক্যালি নিখুঁত এবং ক্ল্যাসিকাল। অর্থোডক্স স্টাইলে সোজা ব্যাটে খেলতে পছন্দ করতেন। পুল এবং স্কয়ার কাটও ভাল খেলতেন। বোথামের 'স্ট্রেইট হিটিং' সম্পর্কে আলাদাভাবে প্রশংসা করা হয়েছে উইজডেনেও। এমনকি 'বিগ হিটার' হিসেবেও তাঁর আলাদা সুখ্যাতি ছিল। লফটেড ড্রাইভ এবং হুক শটে ছক্কা হাঁকানোয় বিশেষ পারদর্শী ছিলেন বিফি।

মজার ব্যাপার হল, ব্যাটিংয়ের ক্ষেত্রেও বোথামের শুরু এবং শেষের গল্পটা অন্যরকম। প্রথম ৫১ টেস্ট শেষে বোথামের ব্যাটিং গড় ছিল ৩৮.৮০। অথচ শেষ ৫১ টেস্টে সেটা মাত্র ২৮.৮৭!

বোথামকে ইংল্যান্ডের সর্বকালের সেরা ক্রিকেটারের স্বীকৃতি দিয়ে থাকেন অনেকেই। ম্যাচ জেতানোর ক্ষমতা বিবেচনায় তাঁর সমকক্ষ খেলোয়াড় সমগ্র ক্রিকেট ইতিহাসেই বিরল। ইংলিশ মিডিয়ার চোখে আধুনিক ক্রিকেটের প্রথম সুপারস্টার হলেন ইয়ান বোথাম! যতদিন খেলেছেন মিডিয়া এবং সমর্থকদের আগ্রহের কেন্দ্রবিন্দু হয়ে থেকেছেন সবসময়। 

উইজডেনের সাবেক চীফ এডিটর ম্যাথু এঞ্জেলের  মতে, “No Englishman since WG Grace not even Jack Hobbs, Wally Hammond, or Kevin Pietersen, had captured the imagination of cricket supporters the way Botham had.”

সাবেক ইংলিশ অধিনায়ক গ্রাহাম গুচের ভাষ্যমতে, “English sport has never produced a superhero like him.”

উইজডেনের ভাষায়, “In the late 1970s and early 1980s, Botham was the world’s leading miracle worker. His comical, unprecedented self-belief was combined with exquisite skill: as a swing-bowling artist, a genius in the slips and either a classical hitter or a beery slogger.”

এর বিপক্ষেও মত আছে অবশ্য। কারও কারও মতে তিনি নাকি ক্রিকেট ইতিহাসের সবচাইতে ওভাররেটেড ক্রিকেটার! তবে যাই বলুন না কেন, সর্বকালের সেরা অলরাউন্ডারদের ছোট্ট তালিকায় বোথামের নামটা থাকবে ওপরের সারিতেই।

শেষ করব দুটি ভিন্ন প্রসঙ্গ দিয়ে। প্রথমত, লেখাটি পড়ে আপনারা নিশ্চয়ই এতক্ষণে জেনে গেছেন যে ফুটবলার হিসেবেও বোথাম ছিলেন যথেষ্ট প্রতিভাবান। চাইলে ক্রিকেট বাদ দিয়ে পেশাদার ফুটবলেও ক্যারিয়ার গড়তে পারতেন। মজার ব্যাপার হল, আন্তর্জাতিক ক্রিকেটার থাকা অবস্থাতেই ১৯৭৮ থেকে ১৯৮৫ সাল পর্যন্ত ইয়েভিল টাউন এবং স্কানথোর্প ইউনাইটেডের হয়ে ইংলিশ প্রিমিয়ার লীগের তৃতীয় স্তরে ১১টি ম্যাচ খেলেছেন বোথাম! ও আচ্ছা বলাই হয় নি, ফুটবলে বোথামের পছন্দের পজিশন ছিল সেন্টার ব্যাক।

দ্বিতীয়ত, ক্রিকেটের পাশাপাশি বিভিন্ন দাতব্য সংস্থার হয়ে তহবিল সংগ্রহের পেছনেও আজীবন কাজ করে গেছেন বোথাম। চ্যারিটি ফান্ড সংগ্রহের লক্ষ্যে তিনি সর্বমোট ১২টি ম্যারাথন বা লং ওয়াকে অংশ নিয়েছেন। এর মধ্যে দীর্ঘতম 'ওয়াক'টি ছিল ৯০০ মাইল! একটি বেসরকারি সংস্থার হিসাবমতে বোথামের সংগৃহীত চ্যারিটি ফান্ডের পরিমাণ প্রায় ১২ মিলিয়ন পাউন্ড!