এশিয়া কাপ

এমন হারে দুঃখ নেই...

জুবাইর

জুবাইর
প্রকাশের তারিখ: 06:55 শনিবার, 29 সেপ্টেম্বর, 2018

|| ডেস্ক রিপোর্ট ||

টুর্নামেন্টের শুরু থেকেই তামিম ইকবাল নামের ব্যাটিং স্তম্ভ বাংলাদেশ দলে নেই। ইনিংসের শুরুটা ভাল হচ্ছিল না একদম। পুরো টুর্নামেন্টে সর্বোচ্চ ওপেনিং জুটি মাত্র ১৬ রানের। প্রথম ১০ ওভারের মধ্যে ২ উইকেট হারানো তো নিয়মিত চিত্র হয়ে গিয়েছিল। 

আধা ফিট বাংলাদেশ ক্রিকেটের আরেক স্তম্ভ সাকিব আল হাসান। কিন্তু দলের জন্য খেলছিলেন প্রচণ্ড ইচ্ছা শক্তি নিয়ে, শরীরের সাথে যুদ্ধ করে। কিন্তু যুদ্ধে শেষ পর্যন্ত পারলেন না সাকিব আল হাসান। আঙ্গুলের ব্যথা বয়ে বেড়ানো এবং প্রচণ্ড চাপে দলের হয়ে পারফর্ম করা, সাকিবের জন্য অবিচার হয়ে যাচ্ছিল। 

তাই ফিরতে হল টুর্নামেন্টের মূল পর্ব শুরু আগেই। এদিকে পুরো দলের ব্যাটিং এর ভার একা বয়ে বেড়াচ্ছিলেন যিনি, সেই মুশফিকুর রহিম পাঁজরের ইনজুরির সাথে লড়াই করছিলেন। আবার পাকিস্তানের ম্যাচে ঝাঁপ দিয়ে বল ধরতে গিয়ে আঙ্গুলে ব্যথা পেলেন মাশরাফি বিন মুর্তজা। 

আর তার উপর আরব আমিরাতের অসম্ভব গরম ও আদ্রতা তো রয়েছেই। শরীর থেকে শক্তি শুষে নেয়ার জন্য যথেষ্ট বলা চলে। পানি শুন্যতায় পেশির টান তো প্রতি ম্যাচের নিয়মিত চিত্র হয়ে গিয়েছিল। প্রায় প্রতিটি ক্রিকেটারকে গরম ও আদ্রতায় ক্যারিয়ারের সবচেয়ে কঠিন পরীক্ষা দিতে হয়েছে তাদের। 

বলা যায়, এবারের এশিয়া কাপে এক চলমান হাসপাতাল বয়ে বেড়াচ্ছিল বাংলাদেশ দল। তবুও বাঁধা বিপত্তি পার করে একজনকে দেখা গেছে এক হাতে ব্যান্ডেজ নিয়েই ব্যাট করতে নেমে গেলেন। একজন পাঁজরে টেপ পেঁচিয়ে সেঞ্চুরি করলেন। আরেকজন ব্যথানাশক ইনজেকশন নিয়ে খেলা চালিয়ে গেলেন।

অধিনায়ককে দেখা গেল, ঝাঁপ দিয়ে ম্যাচের বাঁক বদলে দেয়া ক্যাচ ধরার পর আঙ্গুলে চোট পেতে। আবার খানিকবাদেই আঙ্গুল সামলে মাঠে নামলেন, বল করলেন শতভাগ নিংড়ে দিয়ে। 

তবুও এক ঝাঁক ইনজুরি আক্রান্ত ক্রিকেট নিয়েই বাংলাদেশ দল এশিয়া কাপের ফাইনাল খেলেছে, লড়েছে ঠিক শেষ বল পর্যন্ত। এশিয়ার পাওয়ার হাউজ ভারতকে কাঁপিয়ে দিয়ে চোখে আঙ্গুল দিয়ে দুই দলের মধ্যে পার্থক্য দেখিয়ে দিয়েছে। 

তাও আবার স্কোর বোর্ডে মাত্র ২২২ রানের ছোট্ট মূলধন নিয়েই। তামিম নেই, সাকিব নেই... কিন্তু লিটন দাস, সৌম্য সরকার, মেহেদি হাসান, নাজমুল অপুরা আছে... এভাবে কি গলা উঁচু করে বলার সুযোগ হয়েছিল কখনো? 

এবার হচ্ছে, গর্ব হচ্ছে। বড় ম্যাচে লিটনের বড় হয়ে ওঠা ও বিশ্বকে জানান দেয়ার সেঞ্চুরি তাই প্রমান করে। সঙ্গী হিসেবে তামিম নেই, খেলতে হয়েছে মূলত লোয়ার মিডেল অর্ডারে খেলা মিরাজকে নিয়ে। কিন্তু সিনিয়রের দায়িত্বে বেশ মানিয়ে নিয়ে গড়েছেন ১২০ রানের জুটি।

একই সাথে স্রোতের বিপরিতে দাঁড়িয়ে খেলেছেন ক্যারিয়ার সেরা ১২১ রানের অবিশ্বাস্য ইনিংস। দল করেছে ২২২ রানের মাঝারি রান। এমন স্কোরে ভয়টা ছিল ভারতের পাওয়ারফুল দুই ওপেনার রোহিত শর্মা ও শেখর ধাওয়ানে, যেই জুটি এবারের এশিয়া কাপে ৮৭ গড়ে রান তুলেছে। 

ক্যারিয়ারের দ্বিতীয় ওয়ানডে খেলতে নামা নাজমুল ইসলাম অপুর ভাবনা ছিল ভিন্ন। বাঁহাতি স্পিন না, চায়নাম্যান দিয়ে শেখরকে আউট করেছেন তিনি। রোহিত ব্যাটের মাঝখানটা খুঁজে পেলেও আম্বাতি রাইডুর যম রূপে আবির্ভাব ঘটে মাশরাফির। নিখুঁত লেন্থের বলটি অফ সাইডে খেলতে গিয়ে কট বিহাইন্ড।

সঠিক জায়গায় বল করে রোহিতকেও ফেরায় বাংলাদেশ। রোহিতের বিদায়ে বিশ্বাস ফিরে আসে বাংলাদেশ ক্যাম্পে। বিশ্বাসের ভেলায় চড়ে নিদাহাস ট্রফির নায়ক দীনেশ কার্ত্তিককে সাজঘরে পাঠান মাহমুদুল্লাহ। 

ক্রিজে অবশ্য ঘুমন্ত আগ্নেয়গিরির মত খেলছিলেন মহেন্দ্র সিং ধোনি। যে কোন সময় আগুনের ফুলকি ছড়াতে পারেন তিনি। স্পিনারদের দুই দফা স্টেপ আউট করে বাউন্ডারি হাঁকিয়ে সেই ইঙ্গিত দিচ্ছিলেন তিনি। 

জুটি গড়ে কেদার যাদবকে নিয়ে এগোচ্ছিলেন সঠিক পথে। মাশরাফির 'মেইন ম্যান' মুস্তাফিজ খালি হাতে ফিরে যাওয়ার পাত্র নন। ওয়ানডে ফরম্যাটের কিংবদন্তী ধোনিকে ফাইনালের নায়ক হওয়া থেকে বঞ্চিত করেন তিনি। 
 
এদিকে হ্যামস্ট্রিং ইনজুরি ভাল খেলতে থাকা কেদার যাদবকে মাঠের বাইরে যেতে বাধ্য করে, যার ফলে রবিন্দ্র জাদেজা ও ভুবনেশ্বর কুমার নিজেদের নতুন ব্যাটসম্যান হিসেবে ক্রিজে খুঁজে পান। তিন পেসারের দল বাংলাদেশ ততক্ষণে রান ও বলের পার্থক্য কমিয়ে আনছিল।

স্পিনার মেহেদি হাসান মিরাজ রান খরচা করলেও রিয়াদে অভাব মোচন করে নিচ্ছিলেন মাশরাফি। কিন্তু কতক্ষণ, একে একে উইকেট পতন ও ম্যাচের মোড় বদলের সাথে একজন বোলারের শুন্যতা প্রকট হতে থাকে। 

রুবেল ও মুস্তাফিজের শেষ স্পেলের দুর্দান্ত বোলিংয়ে জাদেজা ও ভুবনেশ্বরের ৪৫ রানের জুটি ভাঙ্গে, কিন্তু ইনজুরি নিয়েই ক্রিজে নামা কেদারকে থামাবে কে? ততক্ষণে নিজের কোটা পূর্ণ করে ফেলেছেন মাশরাফি, মুস্তাফিজ ও রুবেলরা। 

ফের মেহেদি নাকি মাহমুদুল্লাহর অভিজ্ঞতা? একবার দৃশ্যপটে সৌম্য সরকারকে দেখা গেলেও মন বদলে ফেলেন মাশরাফি। রুবেল ও মুস্তাফিজের বোলিংয়ের পর জয় পরাজয়ের মধ্যকার পার্থক্য মাত্র ৬ রানের।

অধিনায়ক অভিজ্ঞতায় বাজি ধরে মাহমুদুল্লাহর হাতে বল তুলে দেন। মাত্র ছয়টি রান। পুরো ৫০ ওভারের অবিশ্বাস্য লড়াইকে বাংলাদেশ বোলিং ও ফিল্ডিংয়ের অধিকাংশ বক্সে টিক মার্ক পেয়েছে। কিন্তু শেষ ওভারের স্নায়ুর পরীক্ষায় কে জিতবে? 

এক, এক, দুই, ডট বল, এক ও একটি লেগ বাই... মাহমুদুল্লাহর অফ স্পিনে সব ফিল্ডার উপরে এনেও সিঙ্গেল থামাতে পারেনি বাংলাদেশ, থামাতে পারে সপ্তমবারের মত ভারতের এশিয়া কাপের শিরোপা জয় করার উল্লাস। 

১০০ ওভারের খেলা, পুরো ম্যাচ জুড়ে বাংলাদেশে কেঁপেছে ভারত। কিন্তু ম্যাচের শেষ বল পর্যন্ত সবটুকু দিয়ে লড়াই করেও শিরোপা জয় হল না। বরং ফিরল সেই পুরনো স্মৃতি, ২০১২, ২০১৬ এশিয়া কাপ ফাইনালে যা হয়েছিল মিরপুরে, ঠিক তারই পুনরাবৃত্তি দুবাইয়ের মাঠেও। 

তবে এবার কলার তুলে মাথা উঁচু করে, প্রতিপক্ষের সাথে শক্ত হ্যান্ডশেক করেই মাঠ ছাড়ল বাংলাদেশ। টুর্নামেন্টের শুরু থেকেই একের পর এক ধাক্কা সহ্য করে মাঠের পারফর্মেন্স ধরে রাখার মত কঠিন কাজটি করতে হয়েছে মাশরাফির বাংলাদেশকে। 

এমন হারে দুঃখ নেই, এমন হার তো বড় স্বপ্ন দেখতে শেখায়। এমন হারের পেছনেই লেখা হয় অবিশ্বাস্য অর্জনের স্ক্রিপ্ট।