ক্রিকেট লিজেন্ডস

কপিল দেবঃ হারিয়ানার হারিকেন

ক্রিকফ্রেঞ্জি করেসপন্ডেন্ট

ক্রিকফ্রেঞ্জি করেসপন্ডেন্ট
প্রকাশের তারিখ: 16:42 শনিবার, 22 সেপ্টেম্বর, 2018

|| ফ্রাইডে স্পেশাল ||

টেস্ট ইতিহাসের 'একমাত্র' ক্রিকেটার তিনি যার রয়েছে ৪০০০ রান এবং ৪০০ উইকেটের 'আল্টিমেট ডাবল' অর্জনের কৃতিত্ব। একদিনের আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে তিনিই সর্বপ্রথম পেরিয়েছিলেন ২০০ উইকেটের মাইলফলক। ইতিহাসের সর্বকালের সেরা অলরাউন্ডারদের শর্টলিস্টেও তাঁর অবস্থান ওপরের সারিতেই। বলছিলাম ভারতীয় ক্রিকেটের প্রথম ফাস্ট বোলিং আইকন, প্রথম বিশ্বকাপজয়ী অধিনায়ক, ‘হরিয়ানা হারিকেন’ খ্যাত কিংবদন্তি অলরাউন্ডার কপিল দেবের কথা।  

 

২০০২ সালে উইজডেন কর্তৃপক্ষ ভারতের শতাব্দী সেরা ক্রিকেটার হিসেবে নির্বাচিত করেছিল কপিল দেবকে। শচীন টেন্ডুলকার ও সুনীল গাভাস্কারের মতো কিংবদন্তিকে পেছনে ফেলে এই পুরস্কারটি জিতে নিয়েছিলেন কপিল।

আশির দশকে একই সঙ্গে চারজন কিংবদন্তি অলরাউন্ডারের উত্থান দেখেছিল ক্রিকেট বিশ্ব। কপিল ছিলেন তাঁদেরই একজন। কপিল-ইমরান-বোথাম-হ্যাডলি এই চারজনকে একযোগে ডাকা হত 'ফ্যাবুলাস ফোর' নামে। 

 

ভারতের ইতিহাসে কেবল সর্বশ্রেষ্ঠ অলরাউন্ডারই নয়; সর্বকালের সেরা ফাস্ট বোলারের নামটাও কপিল দেব। ক্যারিয়ারের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত কপিল ছিলেন দলের এক নম্বর স্ট্রাইক বোলার। বল হাতে একাই জিতিয়েছেন অসংখ্য গুরুত্বপূর্ণ ম্যাচ। টেস্টে পেসার হিসেবে ভারতের পক্ষে সবচেয়ে বেশি উইকেট (৪৩৪), সেরা বোলিং গড় (২৯.৬৪) এবং সেরা বোলিং ফিগারের (৯/৮৩) কীর্তিও তাঁর দখলে। 

 

এমন একটা সময়ে কপিলের আবির্ভাব যখন ভারত ছিল সম্পূর্ণ স্পিন নির্ভর একটা দল। ফাস্ট বোলার তো দূরের কথা, উইকেট নিতে পারে এমন একজন মিডিয়াম পেসার পর্যন্ত ছিল না। আসলে ভারতীয় ক্রিকেটে ফাস্ট বোলিংয়ের কালচারটাই ছিল অনুপস্থিত। তিরিশের দশকে মোহাম্মদ নিসার-অমর সিং জুটির পর বলার মতো পেসার আর একজনও উঠে আসে নি। ফাস্ট বোলার সংকটে হাঁসফাস করতে থাকা ভারতীয় ক্রিকেটে কপিল এসেছিলেন এক পশলা স্বস্তির নিঃশ্বাস হয়ে।

ফ্যাব-ফোরের চারজনই ছিলেন গ্রেট ফাস্ট বোলার। তবে সমসাময়িক ক্রিকেট বিশ্লেষকদের মতে ট্যালেন্ট, স্কিল এবং কোয়ালিটির বিচারে ইমরান, হ্যাডলি কিংবা বোথামের তুলনায় কপিল কিছুটা পিছিয়েই ছিলেন। কপিলের গতিও ছিল তুলনামূলক কম। বোলিং গড় ও স্ট্রাইক রেটের হিসাবেও ফ্যাব-ফোরের বাকি তিনজনের চাইতে বেশ খানিকটা পিছিয়ে তিনি। তবে ম্যাচ বেশি খেলায় সর্বোচ্চ উইকেটের রেকর্ডটা অবশ্য কপিলেরই। 

 

রিচার্ড হ্যাডলি- গড় ২২.৩, স্ট্রাইক রেট ৫০.৮

ইমরান খান- গড় ২২.৮, স্ট্রাইক রেট ৫৩.৭

ইয়ান বোথাম- গড় ২৮.৪, স্ট্রাইক রেট ৫৬.৯

কপিল দেব- গড় ২৯.৬, স্ট্রাইক রেট ৬৩.৯

 

বল হাতে কপিলের সাফল্যের মূল রহস্য ছিল শৃঙ্খলা, ফিটনেস আর ম্যারাথন দৌড়বিদের মত অবিশ্বাস্য স্ট্যামিনা। ক্লান্তিহীনভাবে বোলিং করে যেতে পারতেন ঘন্টার পর ঘন্টা, স্পেলের পর স্পেল। আর ছিল নিখুঁত লাইন-লেন্থ এবং বলকে সুইং করানোর ক্ষমতা। 

 

পারফেক্টলি সাইড অন একশনের কারণে ন্যাচারাল আউটসুইং হত কপিলের বলে। তাঁর সিগনেচার ডেলিভারিই ছিল আউটসুইঙ্গার। ইনসুইঙ্গারও দিতেন তবে কদাচিৎ। 

 

উইজডেনের সাবেক সহসম্পাদক গিডিওন হেই কপিলের বোলিং একশনের বর্ণনা দিয়েছেন এভাবে, “He had the liveliest and least imitable action of all, a skipping, bounding run of gathering energy, and a delivery stride perfectly side-on but exploding at all angles, wrists uncoiling, arms elasticising, eyes afire.”

 

কেবল ফাস্ট বোলারই নন; কপিল ছিলেন একজন অ্যাগ্রেসিভ লোয়ার মিডল অর্ডার ব্যাটসম্যান এবং অ্যাথলেটিক ফিল্ডার। তাঁকে মনে করা হয় আধুনিক হেলমেটবিহীন যুগের সেরা পাওয়ার হিটারদের একজন। পুল এবং হুক শটে পারদর্শী কপিলের মূল দর্শন ছিল একটাই- আক্রমণ। প্রথম বল থেকে প্রতিপক্ষ বোলারদের ওপর চড়াও হতে চাইতেন তিনি। ওয়ানডের স্লগ ওভারে দ্রুত রান তোলায় ছিলেন দারুণ পারদর্শী। এমনকি টেস্ট ম্যাচেও ব্যাট করতেন ওয়ানডে স্টাইলে। 

উইজডেনের ভাষায়, “A natural striker of the ball, full of generous arcs and fearful cleaves, signed with an exuberant pull shot that featured a chorus-line kick from his crossed front leg.”

 

চলুন এক নজরে দেখে নিই কপিল দেবের ক্যারিয়ার হাইলাইটস।

 

★ ১৯৫৯ সালের ৬ জানুয়ারি, হরিয়ানা প্রদেশের রাজধানী চন্ডীগড়ের এক মধ্যবিত্ত পরিবারে জন্মেছিলেন কপিল দেব। তাঁর বাবা ছিলেন একজন নির্মাণ ঠিকাদার। 

 

★ ১৯৭৫ সালে মাত্র ১৬ বছর বয়সে হরিয়ানার হয়ে পাঞ্জাবের বিপক্ষে ফার্স্ট ক্লাস অভিষেক। ৩৯ রানে ৬ উইকেট নিয়ে অভিষেকেই নিজের জাত চিনিয়েছিলেন তিনি। 

 

★ ১৯৭৬-৭৭ মৌসুমে প্রথম ভারতীয় পেসার হিসেবে এক ইনিংসে ৮ উইকেট নেয়ার কৃতিত্ব দেখিয়েছিলেন তিনি। জম্মু-কাশ্মীর (৮/৩৬) এবং বেঙ্গলের (৮/২০) বিপক্ষে ইনিংসে ৮ উইকেট নিয়েছিলেন দুইবার। 

 

★ ১৯৭৮ সালে ফার্স্ট ক্লাস ক্যারিয়ারে প্রথমবারের মত নেন ১০ উইকেট, সার্ভিসেস দলের বিপক্ষে। 

 

★ ভারতের হয়ে কপিলের টেস্ট অভিষেক ১৯৭৮ সালে, ফয়সালাবাদে চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী পাকিস্তানের বিপক্ষে। প্রথম ইনিংসে উইকেটশূন্য থাকলেও দ্বিতীয় ইনিংসে ১২ ওভার বল করে মাত্র ২৫ রানের বিনিময়ে নিয়েছিলেন ১ উইকেট। 

 

বোলিং ফিগার খুব একটা নজরকাড়া না দেখালেও সে ম্যাচে বল হাতে গতির ঝড় তুলেছিলেন কপিল। পেস-বাউন্স দিয়ে পাকিস্তানি ব্যাটসম্যানদের যথেষ্ট ভুগিয়েছিলেন। কপিলের বাউন্সারে ভড়কে গিয়ে পাকিস্তানি ওপেনার সাদিক মুহম্মদ নাকি ড্রেসিংরুম থেকে হেলমেট চেয়ে পাঠিয়েছিলেন! সাদিকের উইকেটটাও পরে তিনিই নিয়েছিলেন।

এ প্রসঙ্গে রামচন্দ্র গুহ তাঁর 'ইন স্পিন্স এন্ড আদার টার্ন্স' বইতে লিখেছেন, “In his second over, the teenager sent a bouncer past the pentangle on Sadiq Mohammad's cap. It was very likely the fastest delivery from an Indian bowler since independence". 

 

★ ক্যারিয়ারের প্রথম টেস্ট ফিফটিটা হাঁকান মাত্র ৩৩ বলে, ৪টি ছক্কার সাহায্যে, করাচিতে পাকিস্তানের বিপক্ষে।

 

★ ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে পরের সিরিজেই পেয়ে যান কাঙ্খিত টেস্ট সেঞ্চুরির দেখা। দিল্লির ফিরোজ শাহ কোটলায় খেলেন অপরাজিত ১২৬ রানের দুর্দান্ত এক ইনিংস। 

 

কপিলের জন্য অবশ্য পুরো সিরিজটাই কেটেছিল দারুণ। ৭ ইনিংসে ব্যাট করে ৬৫.৮০ গড়ে করেছিলেন ৩২৯ রান আর বল হাতে ৩৩.০ গড়ে নিয়েছিলেন ১৭ উইকেট। ভারত সিরিজ জিতেছিল ১-০ ব্যবধানে। 

 

★ ১৯৭৯ সালে অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে হোম সিরিজে দুইবার ইনিংসে ৫ উইকেটসহ ২২.৩২ গড়ে নেন ২৮ উইকেট। এছাড়া ব্যাট হাতে এক ফিফটিসহ করেন ২১২ রান। ভারত সিরিজ জিতেছিল ২-০ তে।

 

★ ১৯৭৯-৮০ সালে চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী পাকিস্তানের বিপক্ষে হোম সিরিজে বল হাতে নিজের আগের সব কীর্তিকে ছাপিয়ে যান কপিল। 

 

৩ বার ইনিংসে ৫ উইকেট এবং ১ বার ম্যাচে ১০ উইকেটসহ মাত্র ১৭.৬৯ গড়ে শিকার করেন ৩২ উইকেট। এছাড়া ২ ফিফটিসহ তাঁর ব্যাট থেকে এসেছিল ২৭৮ রান। ভারত সিরিজ জিতেছিল ২-১ এ।

 

উল্লেখ্য, ভারতের জয়লাভ করা দুটো টেস্টেই জয়ের নায়ক ছিলেন কপিল। মুম্বাইয়ে সিরিজের ৩য় ম্যাচটা জিতিয়েছিলেন ৮ নম্বরে নেমে ৭৯ বলে ৬৯ রানের অনবদ্য এক ইনিংস খেলে। আর মাদ্রাজ টেস্ট জেতাতে অবদান রেখেছিলেন ব্যাটিং-বোলিং দুই বিভাগেই। বল হাতে ১১ উইকেট (৪/৯০ ও ৭/৫৬) নেয়ার পাশাপাশি ব্যাট হাতে খেলেছিলেন ৯৮ বলে ৮৪ রানের ঝড়োগতির ইনিংস।

 

★ ১৯৮০ সালে টেস্ট ইতিহাসের কনিষ্ঠতম খেলোয়াড় হিসেবে (২১ বছর ২৫ দিন) ১০০০ রান ও ১০০ উইকেটের অলরাউন্ডার'স ডাবল অর্জনের কীর্তি গড়েন কপিল দেব, ক্যারিয়ারের ২৫তম টেস্ট ম্যাচে। 

 

★ ১৯৮০ সালে ব্রিসবেনে নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে ক্যারিয়ারের প্রথম ওডিয়াই ফিফটি তুলে নেন কপিল। তাঁর ৯ চার ও ৩ ছক্কায় সাজানো ৫১ বলে ৭৫ রানের ইনিংসের সৌজন্যেই দু'শো রানের কোটা অতিক্রম করেছিল ভারত। 

 

উল্লেখ্য, টেস্ট ক্রিকেটে ভারতের নয়া সেনসেশন কপিল দেবের ওডিয়াই ক্যারিয়ারের সূচনাটা খুব একটা সুখকর ছিল না। প্রথম ১৬ ওয়ানডেতে তাঁর উইকেট ছিল মাত্র ১৭টি এবং ব্যাট হাতে মাত্র ১৭.৩৮ গড়ে সংগ্রহ করেছিলেন ২৭৮ রান।

 

★ ১৯৮১ সালের ঐতিহাসিক মেলবোর্ন টেস্টে দুদলের মাঝে ব্যবধান গড়ে দিয়েছিল কপিলের অসাধারণ এক স্পেল (১৬.৪-৪-২৮-৫)। যার সুবাদে অস্ট্রেলিয়াকে দ্বিতীয় ইনিংসে মাত্র ৮৩ রানে অলআউট করে দিয়ে সিরিজে ১-১ সমতা এনেছিল ভারত। তার চেয়েও উল্লেখযোগ্য ব্যাপার হল, হ্যামস্ট্রিং এবং গ্রোইন ইনজুরিতে ভোগা কপিল সেদিন মাঠে নেমেছিলেন ব্যথানাশক ইনজেকশন নিয়ে!

 

 ★ ১৯৮১-৮২ সালে ইংল্যান্ডের বিরুদ্ধে দেশের মাটিতে সিরিজ জয়ের মূল কারিগর ছিলেন কপিল দেব। ব্যাট হাতে ১ সেঞ্চুরি ও ১ ফিফটিতে ৩১৮ রান করার পাশাপাশি বল হাতে নিয়েছিলেন ২২ উইকেট। 

 

ভারত জিতেছিল ১-০ ব্যবধানে, কপিল হয়েছিলেন ম্যান অব দ্য সিরিজ। 

 

★ ১৯৮২ সালে ইংল্যান্ড সফরে ফিরতি সিরিজেও ব্যাটে বলে যথারীতি উজ্জ্বল ছিলেন কপিল। ভারত সিরিজ হারলেও ব্যাট হাতে ৭৩.০ গড়ে ২৯২ রান ও বল হাতে ১০ উইকেট নিয়ে সিরিজসেরার পুরস্কারটা উঠেছিল কপিলের হাতে। 

 

উল্লেখ্য, সেবার তিন ম্যাচে তিনটি ঝোড়ো ফিফটি হাঁকিয়েছিলেন কপিল। লর্ডসে ৫৫ বলে ৮৯, ওল্ড ট্র্যাফোর্ডে ৫৫ বলে ৬৫, কেনিংটন ওভালে ৬৩ বলে ৯৭! ভুলে যাবেন না এগুলোর সবই কিন্তু টেস্ট ম্যাচে। 

 

★ ১৯৮২-৮৩ সালের ভারত-পাকিস্তান সিরিজটিকে বলা হয় 'ইমরানের সিরিজ'। ইমরান খানের অতিমানবীয় পারফরম্যান্সের সুবাদে (৪০ উইকেট ও ২৪৭ রান) পাকিস্তান জিতেছিল ৩-০ ব্যবধানে। 

 

উক্ত সিরিজে ছন্নছাড়া ভারতের পক্ষে বলার মত কিছু করে দেখাতে পেরেছিলেন এক কপিল দেবই। ৩ বার ইনিংসে ৫ উইকেটসহ নিয়েছিলেন ২৪ উইকেট। 

 

★ ১৯৮৩ সালে শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে একমাত্র টেস্টের জন্য অধিনায়ক মনোনীত করা হয় কপিল দেবকে। পাকিস্তান সফরে ভরাডুবির পর সুনীল গাভাস্কারের স্থলাভিষিক্ত হন তিনি। 

 

★ ১৯৮৩ বিশ্বকাপের আগে পাঁচ ম্যাচের টেস্ট ও তিন ম্যাচের ওডিয়াই সিরিজ খেলতে ওয়েস্ট ইন্ডিজ সফরে গিয়েছিল কপিল দেবের নেতৃত্বাধীন ভারত। টেস্ট সিরিজটা ৩-০ তে হারলেও নিজের সেরাটা দিয়েই লড়াই করেছিলেন কপিল। বল হাতে ১৭ উইকেট নেয়ার পাশাপাশি ব্যাট হাতে ১ সেঞ্চুরিসহ করেছিলেন ২৫৪ রান। 

 

টেস্টের পর ওয়ানডে সিরিজটাও হেরেছিল ভারত। তবে হারলেও অন্তত একটি ম্যাচে জয়ের দেখা পেয়েছিল। ঐতিহাসিক সেই জয়ের নেপথ্য কারিগর ছিলেন কপিল দেব। 

 

ব্যাট হাতে কপিলের মাত্র ৩৮ বলে ৭২ রানের (স্ট্রাইক রেট ১৯০!) 'টর্নেডো' ইনিংসের সৌজন্যে ২৮২ রানের চ্যালেঞ্জিং স্কোর দাঁড় করিয়েছিল ভারত। জবাবে স্বাগতিকরা ২৫৫ রানের বেশি করতে পারে নি। সেদিন বল হাতেও 'ক্যাপ্টেন লীডিং ফ্রম দ্য ফ্রন্টের' ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছিলেন কপিল। ১০ ওভার বল করে মাত্র ৩২ রানে নিয়েছিলেন ৩ উইকেট। 

 

★ ১৯৮৩ সালে কপিল দেবের নেতৃত্বে ইতিহাসে প্রথমবারের মত বিশ্বকাপ শিরোপা ঘরে তুলেছিল ভারত। তুলনামূলক দুর্বল, মাঝারি মানের একটি দলকে সামনে থেকে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন তিনি। 

 

১৯৮৩ বিশ্বকাপে জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে 'মহাকাব্যিক' এক ইনিংস খেলেছিলেন কপিল। সেমিফাইনালে ওঠার আশা জিইয়ে রাখতে সেই ম্যাচে জয়ের কোন বিকল্প ছিল না ভারতের। অথচ প্রথমে ব্যাট করতে নেমে মাত্র ১৭ রান তুলতেই ৫ উইকেট হারিয়ে বসে তারা! সেখান থেকে ভারতের স্কোরটা ৮ উইকেটে ২৬৬ রান পর্যন্ত নিয়ে যাওয়ার পুরো কৃতিত্বটা ছিল কপিল দেবের। ১৬টি চার এবং ৬টি ছক্কার সাহায্যে কপিল খেলেছিলেন ১৩৮ বলে ১৭৫ রানের হার না মানা এক ইনিংস! ৯ম উইকেট জুটিতে সৈয়দ কিরমানিকে নিয়ে যোগ করেছিলেন ১২৬ রান (তৎকালীন বিশ্বরেকর্ড) যেখানে কিরমানির অবদান ছিল মাত্র ২৪! ভারত শেষ পর্যন্ত ম্যাচটা জিতেছিল ৩১ রানে। 

 

'৮৩ বিশ্বকাপজয়ী দলের সদস্য, সাবেক ডানহাতি পেসার বলবিন্দর সান্ধু এক সাক্ষাতকারে বলেছিলেন, “It was tremendous hitting. And very, very calculated hitting. Not slogging but calculated hitting … Only Kapil could play an innings like that.”

 

বিশিষ্ট ক্রীড়ালেখক অরুণাভ সেনগুপ্তের ভাষায়, “Kapil’s innings was built on solid fundamentals and was extended to strokes of ingenuity, from the scorching square cut to the searing cover drive to the agricultural pull stroke, in the manner of Lord Nataraj doing the cosmic Tandav dance.”

 

উইজডেনের চোখে গত শতাব্দীর সেরা ওয়ানডে ইনিংসের তালিকায় ৪ নম্বরে আছে কপিলের ইনিংসটি। ম্যাচের পরিস্থিতি বিবেচনায় এটি ওয়ানডে ইতিহাসের সেরা ইনিংস বলেও মনে করেন অনেকে।

 

ফাইনালে ব্যাট হাতে (৮ বলে ১৫ রান) তেমন কিছু করতে না পারলেও দারুণ নিয়ন্ত্রিত বোলিংয়ে বেঁধে রেখেছিলেন প্রতিপক্ষের রানের চাকা। ১১ ওভার বল করে মাত্র ২১ রানে নিয়েছিলেন ১ উইকেট। পাশাপাশি অবদান রেখেছিলেন ফিল্ডার হিসেবেও। পেছন দিকে ২০ গজ দৌড়ে এসে ডিপ স্কয়ার লেগে অবিশ্বাস্য এক ক্যাচ ধরেছিলেন কপিল। আউট হওয়া ব্যাটসম্যানটির নাম ছিল ভিভ রিচার্ডস! 

 

কপিলের অসামান্য ক্যাচটিকে '৮৩ বিশ্বকাপ ফাইনালের টার্নিং পয়েন্ট এবং বিশ্বকাপ ইতিহাসের সেরা ক্যাচের স্বীকৃতি দিয়ে থাকেন অনেকে।

 

৮ ম্যাচে ১২ উইকেট, ৩৩০ রান আর ৭টি ক্যাচ নিয়ে ভারতের প্রথম বিশ্বকাপ জয়ের মূল কারিগর ছিলেন কপিল দেবই। 

 

 ★ ১৯৮৩ সালে ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিরুদ্ধে আহমেদাবাদ টেস্টে ১০ উইকেট নিয়েও (১/৫২ ও ৯/৮৩) দলকে জেতাতে পারেন নি। ভারত হেরেছিল ১৩৮ রানে। 

 

উল্লেখ্য, টেস্টে পরাজিত দলের পক্ষে সেরা বোলিংয়ের রেকর্ড (৯/৮৩) এটাই। আর কপিলই একমাত্র অধিনায়ক, যিনি এক ইনিংসে ৯ উইকেট নেয়ার কৃতিত্ব দেখিয়েছেন।

 

★ ১৯৮৪ সালে হাঁটুতে অস্ত্রোপচারের পর বোলিংয়ের ধার অনেকটাই কমে গিয়েছিল তাঁর। এ সময় পেস কমিয়ে মনোযোগ দেন অ্যাকুরেসির দিকে। 

 

★ ১৯৮৬ সালে কপিলের নেতৃত্বেই ইংল্যান্ডের মাটিতে ২-০ ব্যবধানে টেস্ট সিরিজ জিতেছিল ভারত। ব্যাট হাতে রান না পেলেও বল হাতে নিয়েছিলেন ১১টি উইকেট। 

 

★ ১৯৮৬ সালে মাদ্রাজের ঐতিহাসিক 'টাই' টেস্টে ডাবল সেঞ্চুরি (২১০) হাঁকানো অস্ট্রেলিয়ার ডিন জোন্সের সাথে যৌথভাবে ম্যাচসেরা হয়েছিলেন কপিল দেব। ১৩৮ বলে ১১৯ রানের দুর্দান্ত একটি ইনিংস খেলেছিলেন কপিল। 

 

★ ১৯৮৭ সালের বিশ্বকাপেও ভারতকে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন কপিল দেব। তবে ইংল্যান্ডের কাছে হেরে বিদায় নিতে হয়েছিল সেমিফাইনাল থেকেই।  

 

★ ১৯৮৭ সালে একটি ওয়ানডেতে ওয়েস্ট ইন্ডিজের দেয়া ২০৪ রানের 'মামুলি' লক্ষ্য তাড়া করতে নেমে এক পর্যায়ে মাত্র ২১ রানে ৫ উইকেট হারায় ভারত। এমন ভয়াবহ বিপর্যয় থেকেও ম্যাচটা আরেকটু হলেই ম্যাচ বের করে নিয়ে যাচ্ছিলেন কপিল। ৬৪ বলে ৮৭ রানের বিধ্বংসী এক ইনিংস খেলে কোর্টনি ওয়ালশের বলে আউট হন তিনি। কপিলের আউটের পরই মূলত ম্যাচ থেকে ছিটকে যায় ভারত। শ্বাসরূদ্ধকর ম্যাচটা ভারত শেষ পর্যন্ত হেরেছিল মাত্র ১০ রানে!

 

★ ১৯৯০ সালে লর্ডস টেস্টে ফলোঅন এড়াতে ভারতের দরকার ছিল ২৪ রান, তবে হাতে ছিল মাত্র ১ উইকেট। এমন অবস্থায় ইংলিশ অফ স্পিনার এডি হেমিংসের বলে টানা চারটি ছক্কা মেরে এক নিমিষেই দলকে ফলোঅনের হাত থেকে বাঁচিয়েছিলেন কপিল।

 

উইজডেনের ভাষায়, “It was murderous assault, calculated to perfection. A sequence of sixes, savage, soaring, spectacular and straight.”

 

★ ১৯৯১ সালের জানুয়ারিতে কলকাতায় অনুষ্ঠিত চতুর্থ এশিয়া কাপের ফাইনালে ওয়ানডে ক্যারিয়ারের একমাত্র হ্যাটট্রিকটি করেন শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে। পর পর তিন বলে তিনি আউট করেন রোশান মহানামা, রুমেশ রত্নায়েকে এবং সনাৎ জয়াসুরিয়াকে। 

 

★ ১৯৯২ সালে পোর্ট এলিজাবেথ টেস্টের দ্বিতীয় ইনিংসে অ্যালান ডোনাল্ডের বিধ্বংসী বোলিংয়ে মাত্র ৩১ রান তুলতেই ৬ উইকেট হারিয়ে বসে ভারত! সেখান থেকে দলীয় স্কোর দুইশ'র ওপর নিয়ে যান কপিল। একপ্রান্ত থেকে পাল্টা আক্রমণ শুরু করে শেষ পর্যন্ত ১৮০ বলে ১২৯ রানের 'দুঃসাহসিক' এক ইনিংস খেলে আউট হন তিনি। 

 

ভারত ম্যাচটা হেরেছিল ৯ উইকেটে, ডোনাল্ডের একার শিকারই ছিল ১২ উইকেট।  

 

★ ১৯৯৪ সালে আন্তর্জাতিক ক্রিকেট থেকে অবসরে যাওয়ার আগে স্যার রিচার্ড হ্যাডলির ৪৩১ উইকেটের রেকর্ডটা ভেঙে ৪৩৪ উইকেটের নতুন রেকর্ড গড়েন কপিল। 

 

উল্লেখ্য, অবসরে যাবার সময় টেস্ট-ওয়ানডে দুই ফরম্যাটেই সর্বোচ্চ উইকেটশিকারি বোলার ছিলেন কপিল। টেস্টে ৪৩৪ আর ওয়ানডেতে ২৫৩ উইকেট। কপিল দেব ছাড়া এই কৃতিত্ব আছে আর মাত্র দুজন বোলারের; ডেনিস লিলি এবং মুত্তিয়া মুরালিধরন। 

 

অনেকেই হয়ত জানেন না, কপিল দেবকে মনে করা হয় ইতিহাসের অন্যতম সেরা 'রানার বিট্যুইন দ্য উইকেট'। তাঁর টেস্ট ক্যারিয়ারের ১৮৪ ইনিংসে কখনোই রানআউট হন নি তিনি। টেস্টে এটাই সবচেয়ে বেশি ইনিংস 'রানআউট বিহীন' থাকার রেকর্ড। দ্বিতীয় ও তৃতীয় স্থানে আছেন যথাক্রমে মুদাসসর নজর (১১৬ ইনিংস) এবং পল কলিংউড (১১৫ ইনিংস)। 

 

চলুন এক নজরে দেখে নিই কপিল দেবের আন্তর্জাতিক ক্যারিয়ার পরিসংখ্যান।

 

#টেস্টঃ 

 

১৮৪ ইনিংসে ৩১.০৫ গড়ে ৫২৪৮ রান। ৮টি শতরানের পাশাপাশি অর্ধশতক হাঁকিয়েছেন ২৭টি। সর্বোচ্চ ১৬৩ রান, বিপক্ষ শ্রীলঙ্কা। 

 

১৩১ টেস্টে ৪৩৪টি উইকেট নিয়েছেন ২৯.৬৪ গড়ে। ইনিংসে ৫ উইকেট ২৩ বার, ম্যাচে ১০ উইকেট ২ বার। সেরা বোলিং ৮৩ রানে ৯ উইকেট, বিপক্ষ ওয়েস্ট ইন্ডিজ। 

 

#ওডিআইঃ

 

২২১ ইনিংসে ২৩.৭৯ গড়ে ৩৭৮৩ রান। স্ট্রাইক রেট ৯৫.০৭! সেঞ্চুরি ১টি, ফিফটি ১৪টি। সেরা ইনিংস ১৩৮ বলে ১৭৫ রান, বিপক্ষ জিম্বাবুয়ে।

 

২২৫ ম্যাচে উইকেট নিয়েছেন ২৫৩টি। বোলিং গড় ২৭.৪৫, ইকোনমি রেট ৩.৭১। ম্যাচে ৪ উইকেট নিয়েছেন ৪ বার। সেরা বোলিং ৪৩ রানে ৫ উইকেট, বিপক্ষ অস্ট্রেলিয়া।

 

#সম্মাননাঃ

 

★ ১৯৮২ সালে ভারত সরকার কর্তৃক পদ্মশ্রী পুরস্কার লাভ করেন।

 

★ ১৯৮৩ সালে উইজডেন মনোনীত বর্ষসেরা ক্রিকেটারের পুরস্কার গ্রহণ করেন।

 

★ ১৯৯১ সালে ভারত সরকার কর্তৃক পদ্মভূষণ উপাধিপ্রাপ্ত হন।

 

★ ২০০২ সালে উইজডেন মনোনীত শতাব্দী সেরা ভারতীয় ক্রিকেটার নির্বাচিত হন।

 

★ ২০১০ সালে আইসিসি ক্রিকেট 'হল অব ফেমের' সদস্যভুক্ত হন।

 

শেষ করব কপিল দেবের জীবনের একটি স্মরণীয় ঘটনা দিয়ে। কপিলের বয়স তখন তেরো কি চৌদ্দ। ভারতীয় ক্রিকেট বোর্ডের তত্ত্বাবধানে প্রতিভাবান কিশোরদের নিয়ে মুম্বাইতে চালু করা হয় একটি অস্থায়ী ট্রেনিং ক্যাম্প। কপিলও ছিলেন সেই অনুশীলন ক্যাম্পে। প্রখর রৌদ্রের মধ্যে ছেলেদের প্রচুর খাটানো হত সেখানে। অথচ খাটুনি অনুযায়ী খাবারের পরিমাণ ছিল খুবই কম; দুটো রুটি আর সামান্য ডাল-তরকারি। এই নিয়ে খেলোয়াড়দের মধ্যে একটা চাপা ক্ষোভ কাজ করত। এদিকে অসন্তোষ চেপে রাখতে না পেরে ক্যাম্পের খাবার বয়কট করে বসেন কপিল।

 

বয়কটের কথা শুনে ক্যাম্পের ইনচার্জ কেকি তারাপোরে এসে কপিলকে জিজ্ঞেস করেন, “কী ব্যাপার? আমাদের দেয়া খাবার নাকি তোমার পছন্দ হচ্ছে না?” কপিলের তাৎক্ষণিক জবাব, “না স্যার। আমি একজন ফাস্ট বোলার। আমার আরও ভাল খাদ্যের প্রয়োজন।” তারাপোরে নাকি তখন বিদ্রুপের হাসি হেসে বলেছিলেন, “ওমা! তুমি ফাস্ট বোলার! ভারতে আবার কোন ফাস্ট বোলার আছে নাকি?”

 

তারাপোরে কি সেদিন জানতেন যে এই তেরো বছরের কিশোরই হতে চলেছে ভারতীয় ইতিহাসের প্রথম ফাস্ট বোলিং গ্রেট!