ভবিষ্যৎ ভাবনা

সমস্যার মূলে দূষিত ক্রিকেট সংস্কৃতি?

জুবাইর

জুবাইর
প্রকাশের তারিখ: 14:47 শুক্রবার, 17 আগস্ট, 2018

|| ক্রিকফ্রেঞ্জি করেসপন্ডেন্ট ||

বাংলাদেশ ক্রিকেটের সোনালি প্রজন্মের আড়ালে উঁকি দিচ্ছে শঙ্কায় ভরা ভবিষ্যৎ। বাংলাদেশের তরুন ক্রিকেটরদের একটি বড় অংশ অধাবাহিকতা, মাঠের বাইরে বিশৃঙ্খলা ইস্যুতে বারবার নেতিবাচক শিরোনামের জন্ম দিচ্ছে। 

ক্রিকেট বোর্ড দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দেয়ার পরও বিপথেই চলছে এই তরুন ক্রিকেটাররা। অনেকে বার বার সুযোগ পেয়েও সেই সুযোগ কাজে লাগাতে পারছে না। মানসিক দুর্বলতার কারনে কঠিন পরিস্থিতিতে দলকে বিশেষ পারফর্মেন্স দিতে ব্যর্থ হচ্ছে তরুনরা।

আরও স্পষ্ট করে বলতে গেলে, দলের সিনিয়র ক্রিকেটারদের যৌথ পারফর্মেন্স ব্যতীত জয়ের দেখা পায় না বাংলাদেশ। এক কথায় তরুনদের এমন পারফর্মেন্সে খুব একটা আশার আলো দেখছেন না ক্রিকেট বিশ্লেষকরা। 

বাংলাদেশের সিনিয়র ক্রিকেটারদের প্রিয় মেন্টর নাজমুল আবেদিন ফাহিমও রয়েছেন সেই দলে। 'বিজয়, সাব্বির, মোসাদ্দেক সবাইকেই আমরা অনেক আগে থেকে দেখেছি, এদের সম্ভাবনার কথা আমরা জানি। বিভিন্ন সময় তারা সেটা করে দেখিয়েছে।

'ভীতিকর বিষয় হচ্ছে তাদের এখন যে অবস্থানে থাকার করা, তারা সেই অবস্থানে নেই। আর আমি বারবারই বলি, আমরা যেভাবে তাদের দেখেছি শুরু থেকে, সেই বিষয়টা ভুল ছিল। আমরা ওদেরকে নেতা হওয়ার সুযোগ দিচ্ছি না, আবার আমরা ওদেরকে পরিণত হিসেবেও দেখছি না। আমরা চাই ওরা সাকিব বা তামিমদের ছায়ায় বেড়ে উঠবে, যা আদতে ভুল। 

'যেটা হওয়া উচিত ছিল, মোসাদ্দকের উচিত ছিল সাকিবের চাইতে এখন ভাল ব্যাটিং করা। সাব্বিরের উচিত ছিল তামিমের চেয়ে ভাল ব্যাটিং করা। যেন দশ বছর পরে এরা যদি আরও ভালো খেলে তাহলে আমরা আরেকটা উচ্চতায় যেতে পারি। কিন্তু এমনটা হয়নি। ওরা অনেক মেধাবী, এখনকার ক্রিকেটারদের চাইতেও অনেকে মেধাবী। 

'কিন্তু ওদের গড়ে তোলায় ভুল আছে। আর এদের মধ্যেও আমি কোনো ব্যক্তিগত উদ্যম দেখি না। কেননা সাকিব, তামিম রিয়াদদের আমরা দেখেছি তারা কি পরিশ্রমী ছিল। জাতীয় দলকে ভাল উচ্চতায় নিতে এরা অনেক পরিশ্রম করেছে, নিজের জন্য না কিন্তু। তো এখনকার যারা তরুণ তাদের মধ্যে ওই স্পৃহাটুকু নেই।'

প্রশ্ন হচ্ছে কেন এই প্রজন্মের ক্রিকেটাররা বড় হতে পারছে না? ভুল গুলো কি শুধুই ক্রিকেটারদের হচ্ছে? অবশ্যই না। বাংলাদেশ ক্রিকেটের দূষিত সংস্কৃতি এর জন্য অনেকাংশে দায়ী। এখানে ক্রিকেটারদের যোগ্য সম্মান দেয়া হয় না বললেই চলে। 

ঘরোয়া ক্রিকেটে ক্রিকেটারদের পারিশ্রমিক থেকে শুরু সব কিছুতেই অপেশাদারি আচরণ করা হয় তাদের সাথে। ক্রিকেট বোর্ডের কর্তা ব্যক্তিরা ক্রিকেটারদের তাদের বেতনভুক্ত কর্মচারীর দৃষ্টিতে দেখে। যার কারনে তরুন ক্রিকেটারদের ব্যক্তিত্বের বিকাশ হয় নি।

শুধু তাই নয়, তরুন ক্রিকেটারদের ক্রিকেট মস্তিস্ক শাণিত করার জন্য যথেষ্ট ম্যাচ খেলার সুযোগ করে দেয় হয়নি তাদের। স্কিল ট্রেনিংটাই বেশি হয়েছে তাদের। ম্যাচ প্র্যাকটিসের অভাব বড় পর্যায়ে এসে ধরা পড়ছে। 

খালেদ মাহমুদ সুজন, বিসিবি গেইম ডেভলপমেন্ট কমিটির প্রধান এই বিষয়টি বাংলাদেশ ক্রিকেটের হুমকি হিসেবে দেখছেন। 'তাদের ম্যাচ খেলার সংখ্যাটা কমে যাচ্ছে। যেটা আমাদের ক্রিকেটের জন্য জন্য বড় একটা হুমকি হয়ে গেছে। 

'প্রতিটি জেলার ছেলেরা কিন্তু কষ্ট করে। কিন্তু সমস্যা হচ্ছে তাদের গেম সেন্সের খুব অভাব। ক্রিকেটে সবচে বড় ব্যাপার গেম সেন্স। যখন বিদেশি কোচরা আসে তখন একটি বিষয়য়েই অভিযোগ করে ‘আপনাদের ছেলেদের নলেজ কম।’ 

'এর কারণ একটাই, আমাদের ছেলেরা এখন কম ম্যাচ খেলছে। সেটা বড় ব্যাপার এবং আমার মনে হয় বোর্ড থেকে ইনস্পায়ার কর উচিৎ যেন লিগগুলো অন্তত হয়। তাহলে ওখানকার তরুণ ছেলেগুলো ম্যাচ খেলতে পারবে, সুযোগ পাবে এবং গেম সেন্স বাড়বে। এবং ক্রিকেটকে এটা দারুনভাবে সাহায্য করবে।'

এই সংস্কৃতি চলতে থাকলে বাংলাদেশ ক্রিকেটের কাঠামোতে মরচে ধরা শুরু করবে। অথচ মাশরাফি-সাকিবদের দেখানো পথে আরও কয়েকধাপ এগিয়ে যাওয়া দরকার ছিল বাংলাদেশ ক্রিকেটের।

বেশি দূর নয়, পাশে দেশ ভারতে চোখ দিলেই সঠিক ক্রিকেট সংস্কৃতির উদাহরণ পাওয়া যায়। সাবেক গ্রেট সুনিল গাভাস্কার ক্রিকেটকে বিদায় জানান ১৯৮৭ সালে। তার দুই বছর পর আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে পা রাখেন শচিন টেন্ডুলকার। 

২৪ বছর আন্তর্জাতিক ক্রিকেট শাসন করার পর অবসর নেন শচিন, ততদিনে ভিরাট কোহলি ভারতীয় ক্রিকেটের পোস্টার বয় হওয়ার জন্য প্রায় প্রস্তুত। শচিনের অবসরে কোহলিই হলেন ভারতীয় ক্রিকেটের মহাতারকা। 

মাঠের পারফর্মেন্স দিয়েই কোহলি এখন আধুনিক ক্রিকেটের মহান ক্রিকেটারদের কাতারে জায়গা করে নিচ্ছেন। একটু যদি উপমহাদেশের আরেক বিশ্বকাপ জয়ী দল পাকিস্তানের দিকে তাকাই, সেখানেও দেখতে পাবেন একই নমুনা। 

ব্যাটিং এর দিক থেকে জহির আব্বাস, জাভেদ মিয়াদাদদের পর ধারা বজায় রেখে তাদের ছাড়িয়ে গেছেন সাইদ আনোয়ার, ইনজামাম উল হক, ইয়নিস খানরা। হালের বাবর আজমরা অতীতের মহান ক্রিকেটারদের ছাড়িয়ে নতুন উচ্চতায় পৌঁছে যাওয়ার স্বপ্ন দেখাচ্ছেন।

অর্জুনা রানাতুঙ্গার দলকে বলা হতো লঙ্কান স্বর্ণযুগের দল। সনাথ জয়সুরিয়া, অরবিন্দ ডি সিলভাদের ব্যাটিং রেকর্ড বেশিদিন স্থায়ী হতে দেয়নি লঙ্কানদের পরের প্রজন্ম। কুমার সাঙ্গাকারা, মাহেলা জয়বর্ধন, টিএম দিলশানরা তাদের সময় অন্যতম সেরা ব্যাটসম্যানদের একজন।

বর্তমান মাহেলা-সাঙ্গাকারাদের অবসরে থেমে যায় নি লঙ্কান ক্রিকেট। সাময়িক ধাক্কা সামলে ঠিকই ঘুরে দাঁড়াচ্ছে ম্যাথিউসদের শ্রীলঙ্কা। কুসাল মেন্ডিসদের মত তরুন প্রতিভাকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠছে লঙ্কান ব্যাটিংয়ের ভবিষ্যৎ।

বাংলাদেশ ক্রিকেটে আকরাম খান, আমিনুল ইসলাম বুলবুল, মিনহাজুর আবেদিন নান্নুদের পর হাবিবুল বাসারদের দেখানো পথেই এগিয়েছে আশরাফুলরা। তারপরের প্রজন্ম বাংলাদেশ ক্রিকেটকে নিয়ে গেছে আরেক ধাপ উঁচুতে। 

মাশরাফি-মাহমুদুল্লাহদের কয়েক বছর পরেই সাকিব-তামিম-মুশফিকদের উত্থান বাংলাদেশ ক্রিকেটে বিশ্ব দরবারে নতুন শক্তিতে পরিনত করেছে। ৯০'র দশকের শ্রীলঙ্কার মত মাশরাফি-সাকিবদের এখনকার দলকে বাংলাদেশের সোনালি প্রজন্ম বলা চলে। 

এই সোনালি প্রজন্মের পরে বাংলাদেশ ক্রিকেটের কি হবে, সেটা সময়ই বলে দিবে।